এক সমুদ্র প্রেম [পর্ব-২২]

পিউয়ের গাল ভিজে চুপচুপে। ঘন পাপড়ি বেঁয়ে পানি পরছে এখনও।

দুরুদুরু বুক কাঁ*পে। ভেতরটা ছটফটায়। উদগ্রীব,ব্যকুল চোখদুটো সম্মুখের লম্বাচওড়া মানুষটার মুখমন্ডলে। এই যে সে কাঁ*দলো, অনেক শোকে হা-হুতাশ করল, এসব কী ধূসর ভাই কে পারল ছুঁতে? কা*ন্নার তোপে সে যে একটু হলেও মনের কথা বলেছে,সামান্য ইঙ্গিতও কি পেলেন না উনি?

ধূসর দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে। নির্জীব,শান্ত,উদ্বেগহীন চাউনী তাকে বিভ্রান্ত করছে। এই চোখে ভাষা নেই। থাকলেও তার ক্ষমতা নেই পড়ার। তবু পিউ ক্লান্ত হয়না,এক যোগে চেয়ে রয়। শেষমেষ ধূসরই দৃষ্টি ফেরাল। আরেকদিক তাকিয়ে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেলল। যেন হাওয়ায় উড়িয়ে দিল অভিপ্রায়। পরপর আবার তাকাল পিউয়ের দিকে। প্রখর তপ্ত স্বরে বলল,

‘ আমি সদর দরজা পার হওয়ার আগে,তোকে টেবিলে দেখতে চাই। দ্বিতীয় বার যেন ডাকতে না হয়!’

পিউয়ের হৃদপিণ্ড দুভাগ হয়ে গেল ক*ষ্টে। হতাশ, আ*হত হলো যন্ত্র*নায়। এতটা, এতটা বলার পরেও ধূসর ভাই বুঝলেন না? তার চোখের জল পা*ষন্ড মানুষটাকে স্পর্শ করল না? এ কেমন পাথুরে মানব কে মন দিলি পিউ? পিউয়ের ভেজা নেত্রদ্বয়, বিস্ময় সমেত চেয়ে চেয়ে দেখল ধূসরকে। মানুষটা এক দন্ড সময় ব্যয় করেনা চোখ মেলাতে। এদিক-ওদিক দেখে ছোট করে বলে,

‘ আয়।’

এরপর ঘর ছাড়ে। নড়তে থাকা পর্দার দিক তাকিয়ে পিউয়ের অশ্রু টুপ করে ঝরে আসে গালের ওপর। মনে মনে হা*হাকার করে বলল,

‘ বুকটা দুম*ড়ে মু*চড়ে দিলেন ধূসর ভাই। এতটা ইমোশোনলেস একটা মানুষ কী করে হয়?’

তখনই বাইরে থেকে ফের পুরু কণ্ঠ ভেসে আসে,

‘ কী হলো?’

পিউ নীচের ঠোঁট কাম*ড়ে ধরে। নিঙড়ে আসা কা*ন্না আটকায়। চোখ মুছে,শক্ত করে মন। যে মানুষ ভালোবাসা বোঝেনা তার সামনে নিজেকে দূর্বল করার কোনও প্রয়োজন নেই। ধূসর ভাই অভিনয়ে কত পঁটু সেও দেখে ছাড়বে। পিউ হাঁটা ধরে। তাকে দরজা গলে বাইরে আসতে দেখে ধূসর নেমে যায় নীচে।

পুষ্প ধূসরকে সিড়িতে দেখেই ফটাফট ফোন রেখে দিলো পাশে। মন দিলো খাওয়ায়। এতক্ষন বলে বলেও যা করাতে পারেননি মিনা বেগম। মারিয়া আর বর্ষা বাদে বাকী সব ছোটরা এখানেই। সে ভাত নিয়ে বর্ষার ঘরে গিয়েছে। বউ মানুষ, দুহাত ভরে মেহেদী পরেছে। আজ আর হাতে পানি ছোঁয়াবে না বলে মারিয়াই খাইয়ে দেবে।

ধূসর বেরিয়ে যায়না,বরং এসে দাঁড়াল টেবিলের কাছে। পেছনে গুটিগুটি পায়ে পিউকে নামতে দেখেই পুষ্প ভ্রুঁ উঁচিয়ে মাকে বলল,

‘ কী? বলেছিলাম না?’

মিনা বেগম বিহ্বল চেয়েছিলেন। তখন ভাবলেন ধূসর রুমে যাচ্ছে। দুটোকে নামতে দেখে বুঝে ফেললেন ঘটনা কী! অতি*ষ্ঠ ভঙিতে মাথা নাড়লেন দুপাশে। না,তার মেয়েটাকে টাইট দিতে ধূসরের জুড়ি নেই।

পিউ এসে দাঁড়াতেই ধূসর চেয়ার টেনে দেয়। গোমড়ামুখে ইশারা করে ‘ বোস।’

পিউ বসল। ঠিক মুখোমুখি পরল শান্তা। মাংসের হাড় হাতে তুলে বসে সে। চিবোতেও পারছেনা ধূসরকে দেখে। ভাবসাব কমে যাবে না? পিউয়ের গা পিত্তি জ্ব*লে গেল ওকে দেখতেই। বিরক্তি নিয়ে চোখ ফিরিয়ে মায়ের দিক তাকাল।

‘ ভাত দিচ্ছোনা কেন? ‘

রা*গটুকু সব ঝেড়ে দিলো ওনার ওপর। ভদ্রমহিলা হতভম্ব হয়ে ধূসরের দিক তাকালেন। ধূসর বলল

‘ তার ছি*ড়ে গেছে তোমার মেয়ের। খাবার দাও,যদি জোড়া লাগে!’

পিউ মাথা নামিয়ে দাঁত চে*পে ধরে। ধূসর,শান্তা দুটোকেই এখন অসহ্য লাগছে। একজন তার ভালোবাসার দিক হাত বাড়িয়েছে, অন্যজন বুঝেও না বোঝার ঢং করছে!

মিনা বেগম মেয়েকে ভাত বেড়ে দিয়ে ফিরে গেলেন কাজে। যে যার মত খেয়ে উঠে যাচ্ছে। সুপ্তি,রাদিফ রোহান,মৈত্রী তাদেরও খাওয়া শেষ। অথচ পুষ্পর অর্ধেকও হয়নি। বরাবর আস্তেধীরে খায় সে। পিউ প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করলেও শান্তা ইচ্ছে করে বসে আছে। পিউ চোখা চোখে একবার পাশে তাকাল। ধূসর নেই। হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। ভাবল চলে গেছে। আঙুলের ভাত ঝেড়ে প্লেটে ফেলল।

খাওয়ার ইচ্ছে নেই একদম। খিদেটাই মৃত। পিউ উঠতে গিয়েও শান্তার দিক তাকাল একবার। সে নিপুন যত্নে আঙুলে ভাত তুলে মুখে পুরছে। যেন ভাত,আঙুল কেউ ব্যা*থা না পায়। আবার নাজুক চোখে তাকাচ্ছে তার পেছনে।

পিউয়ের কপাল বেঁকে আসে। শাকচূন্নিটা কী দেখছে? সে তৎক্ষনাৎ পেছন ঘুরে তাকাল। ধূসর চেয়ারে বসে। ফোনে চোখ।

অথচ পিউয়ের ব্রক্ষ্মতালু অবধি জ্ব*লেপু*ড়ে ছারখার হয়ে গেল। কটম*টিয়ে ফিরে তাকাল শান্তার দিকে। কর্ক*শ কন্ঠে বলল,

‘ খাওয়ার সময় এদিক ওদিক কী দেখিস তুই? ‘

শান্তা থতমত খেল। পিউয়ের কথায় সবগুলো দৃষ্টি নিক্ষেপ হলো ওর দিকে। তার বুঝতে বাকী নেই পিউ দেখে নিয়েছে। যদি কাউকে বলে দেয়? সে সেকেন্ডের মধ্যে ভদ্র মেয়ে হয়ে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে খাবার খায়। উঠে যায় হাত ধুঁতে। পিউ ভাতের লোকমা মুঠো করে চে*পে ধরে। এইভাবে যদি শান্তার টুঁটি-টাও টি*পে দিত পারত!

ঠিক তখনি দেখল ধূসরও বেসিনের দিকে যাচ্ছে। পিউয়ের কলিজা ছ*লাৎ করে ওঠে। ধূসর ভাই শান্তার পেছনে গেলেন কেন? সে অচিরাৎ উঠে দাঁড়াল। পুষ্প জিজ্ঞেস করল

‘ কী হয়েছে?’

‘ আসছি।’

****

‘ এই মেয়ে!’

হঠাৎ পুরুষালি স্বরে চমকে উঠল শান্তা। তটস্থ হয়ে ঘুরে তাকাল। ধূসরকে দেখে গুটিয়ে গেল একধাপ। ধূসর পা ফেলে এগিয়ে আসে। মুখোমুখি দাঁড়ায়। সরাসরি শুধায়,

‘ কী লিখেছো হাতে?’

শান্তার বুক ধ্বক করে ওঠে। উনি জানলেন কী করে? অবুঝের ভাণ করে বলল ‘ ককই,কী লিখেছি?

‘ হাত দেখাও।’

শান্তা চুপসে গেল, ভ*য় পেল। দেখানোর বদলে উলটে লুকিয়ে নিলো পিঠের কাছে। ধূসর মৃদূ হাসল। শান্ত কণ্ঠে বলল,

‘ সকালে বলেছিলাম,শুধরে যেতে। ছোট মানুষ বলে কিছু বলিনি। তার মানে এই নয় যে, তোমাকে সিগন্যাল দিয়েছি আমার পেছনে ঘোরার।’

শান্তা মাথা নামিয়ে নিলো। ধূসর আবার বলল,

‘ হাতে কী লিখেছ আমি জানিনা। তোমার হাত, যা ইচ্ছে লিখতেই পারো। তবে এতে আমি,বা আমি সংযুক্ত কোনও সামান্য বিষয়ও যদি থাকে,সেটা নিয়ে তো একশবার মাথা ঘামাব।’

ধূসরের গুরুতর স্বর ছোট্ট মেয়েটাকে কাঁ*পিয়ে তোলে। বাড়ির কেউ শুনলে রক্ষে নেই। লোকটা তো অতিথি,সাথে কাউকে মানেনা শুনেছে। ওনার কী যায় আসবে? আসবেনা। শহীদ হলে সেই হবে ।

শান্তা মাথা নীচে রেখেই বলল ‘ আপনার ব্যাপারে কিছু লিখিনি, সত্যি বলছি।’

ধূসর তীক্ষ্ণ চোখে তাকায়। মিথ্যে শুনে মেজাজ খারাপ হয়। তবুও ঠান্ডা স্বরে বলল,

‘তোমার বয়স আমি পেরিয়ে এসছি। গতকাল থেকেই আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিলে,হাসছিলে কী মনে হয়? আমি বুঝিনি? বয়স কম,বুঝবেও কম। চোখের দেখায় কাউকে ভালোলাগা মানেই ভালোবাসা নয়। আর তোমার সঙ্গে তো এসব কথা আলোচনা করতেও আমার অস্বস্তি হচ্ছে। তবুও বলছি,পড়াশোনা করার সময় এখন,বইয়ে মন দাও। নাহলে আমিও বাধ্য হব, কথাগুলো তোমার বাবা মুত্তালিব মজুমদারের কানে দিতে।’

শান্তার চোয়াল ঝুলে পরে। চকিতে তাকায়। ঘনঘন মাথা নেড়ে ভী*ত কণ্ঠে বলে,

‘ না না, বাবাকে বলবেন না। আমি আর এমন করব না।’

‘ মনে থাকবে?’

শান্তা মাথা দোলাল।

ধূসর যেতে নিয়ে আবার দাঁড়াল। ফিরে তাকিয়ে বলল,

‘ সকাল হওয়ার আগেই হাতের লেখা মুছে ফেলবে। যদি শুনতে পাই, তা হয়নি, তোমার বাবাকেও দরকার হবেনা। ভালো বিচার এই ধূসরও করতে পারে। ‘

শান্তা ঢোক গিলল। ধূসরের মা*রামা*রির খবর যেখানে গ্রাম ছড়িয়েছে,সেখানে তার কানে আসতে বাকী নেই। যে লোক অন্যের গ্রামে এসে মানুষ পেটা*য়,তার বিচারের আসা*মী হওয়ার সাহস আছে ওর?

**

পিউ ছুটে এসে বসল কেদারায় । তাড়াহুড়োয় ওড়নার কোনাটা আটকাল কাঠে। চেয়ারের পায়ায় হোঁচ*ট খেয়েছে,পা বেঁধেছে। অথচ ভ্রুক্ষেপ নেই। তড়িঘড়ি করে মাখা ভাতে হাত ডোবাল। ব্যস্ততা দেখাল থালায়। পুষ্প কপাল কুঁচকে বলল,

‘ হয়েছে কী তোর? এরকম করছিস কেন? কোথায় গেছিলি?’

পিউ কথা বলেনা। আনন্দে তার দম আটকে আসছে। হাত-পা কাঁ*পছে। হাঁ*সফাঁ*সে আঙুল চলছে না। এতক্ষন দুঃ*খে খেতে পারেনি,এখন খুশিতে। একটু পরেই ধূসর এলো। ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে পুষ্পকে বলল,

‘ প্লেট খালি হওয়া অবধি ও যেন না ওঠে, এটা দেখার দায়িত্ব তোর।’

পুষ্প মাথা হেলিয়ে জানাল ‘ আচ্ছা।’

ধূসর বেরিয়ে গেল আবার। জোরে শ্বাস টানল পিউ। চোখ বুজে চট করে মাথাটা এলিয়ে দিল পেছনে। পুষ্প উদ্বীগ্ন হয়ে বলল,

‘ কী রে, শরীর খা*রাপ লাগছে?’

পিউ ওমন হয়েই দুদিকে মাথা নাড়ে। আই-ঢাই করে বলে,

‘ আমার খুশিতে ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে আপু।’

পুষ্প ভড়কে বলল ‘ এসব কী কথা?’

পিউ সোজা হয়ে তাকাল। পুষ্পর হাত নিয়ে বুকের কাছে ধরে বলল

‘ এই দ্যাখ,কী জোরে কাঁ*পছে! মনে হচ্ছে লাফ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। একটা স্কচটেপ আনতো,হার্টটাকে আটকে রাখি।’

পুষ্প ভ্যাবাচেকা খেল। সাথে নাকমুখ কুঁচকে বলল ‘ ‘ধূসর ভাই ঠিকই বলেছেন,তোর মাথার তার আসলেই ছেড়া। পাগল কোথাকারে!’

মুখ বেঁকিয়ে হাত ধুঁতে চলে গেল সে। পিউ সেদিক চেয়ে মনে মনে বলল,

‘ পাগল কী আজ হয়েছি? ধূসর ভাইয়ের প্রেমের হাসপাতালে পেশেন্ট আমি। ওনার চিকিৎসা ছাড়া সুস্থ হবোনা।’

****

সুমনা বেগম প্লেটে ভাত মেখে ঘুরছেন। দু টুকরো মুরগির মাংস,আর একটু আলো ডলে ডলে মেখেছেন। রিক্তটা এখনও ঝাল খেতে পারেনা। কিন্তু কথা হলো ছেলেটা কই? সেই থেকে খুঁজছেন হদিস নেই। পুরো বাড়িময় ঘুরলেন,একে- ওকে জিজ্ঞেস করলেন,কেউ বলতে পারল না। চিন্তায় এখন অবস্থা শোচনীয় তার। গ্রামের বাড়ি,আশেপাশে কত ঝোঁপঝাড়। বিশাল বিশাল পুকুর,হাওড়,ছেলে তো সাতার ও জানেনা। মায়ের মন ঝুপ করে আশ*ঙ্কায় ডু*বে গেল। অধৈর্য হয়ে ভাতের প্লেট রেখে ঘর থেকে বের হলেন। চললেন বাইরে। আনিস তো সেখানেই আছেন। ওখানে থাকলেও থাকতে পারে।

তিনি যাওয়ার আগেই দরজা দিয়ে ঢুকল সাদিফ। দুঁকাধে রিক্ত বসে। দুজন হুল্লোড় করতে করতে প্রবেশ করল। ছেলেকে দেখে স্বস্তির শ্বাস নিলেন সুমনা। এগিয়ে গেলেন দ্রুত। মৃদূ ধম*কে বললেন

‘ এই ফাজিল ছেলে,কোথায় ছিলে তুমি?’

রিক্ত আধোবুলিতে বলল ‘ বাইলে।’

‘ বাইরে গেলে মাকে জানাতে হয়না? নামো এখন, খাবে।’

খাওয়ার কথা শুনেই রিক্ত চোখ বড় বড় করল। দুদিকে প্রচন্ড জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল,

‘ না না কাবনা।’

‘ চুপ,কোনও কথা নয়,এই সাদিফ নামা তো দুষ্টুটাকে।’

সাদিফ নামাতে গেল,রিক্ত উলটে আষ্ঠেপৃষ্ঠে খা*মচে ধরল তার চুল। কিছুতেই নামবে না। সাদিফ চেঁচিয়ে উঠল,

‘ আ ছোট মা! চুল ছিড়ে নিলো তোমার ছেলে।’

পিউরা টেলিভিশন দেখছিল। এই দৃশ্যে হাসিতে ফেঁটে পরল সব। সুমনা বেগম প্রচন্ড জোর খাটিয়ে কোলে নিলেন ছেলেকে। ভাত খেতে হবে,ভাবতেই শোকে,দুঃ*খে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁ*দে দিল রিক্ত। তিনি কানেই তুললেন না। এসব রোজকার ব্যাপার। নিরুদ্বেগ ভঙিতে ঘরের দিকে এগোলেন।

এদিকে সাদিফ হাঁ*পিয়ে গেছে। কোমড়ে হাত দিয়ে শ্বাস নিল সে। রিক্তর টা*নাটানিতে এলোমেলো চুল হাত দিয়ে গোছালো। এরপর, গিয়েই ধপ করে বসে পরল পিউয়ের পাশে। তার মনোযোগ ততক্ষনে টিভি পর্দায় ঘুরে গেছে। সাদিফ বরাবরের মত নির্দেশ দিলো,

‘ যা, পানি নিয়ে আয়!’

পিউ তাকাল। কপালে ভাঁজ। ঠোঁট উলটে বলল,

‘ বেড়াতে এসেও কাজ করাবেন?’

‘ করাব,যা।’

পিউ অনাগ্রহেও উঠতে নিলে, মারিয়া আগ বাড়িয়ে বলল,

‘ আমি আনছি। তুমি বোসো।’

পিউ খুশি হয়ে মাথা নাড়ল। আবার ঝটপট বসে গেল। মৈত্রী চঞ্চল পায়ে যায় পানি আনতে। সাদিফ অবাক হয়ে চেয়ে থাকল তার যাওয়ার দিক। এই মেয়ের ভাবগতি কেমন না? আজ সকাল থেকেই দেখছে,অকারনে ঘুরছে চারপাশে। কেমন কেমন করে তাকাচ্ছে। যার থেকে এসব আশা করে তার নাম নেই। কোথাকার কোন….

সে একবার চাইলো সিরিয়ালে মনোযোগী পিউয়ের দিকে। এর মধ্যেই পানির গ্লাস এনে বাড়িয়ে দিল মৈত্রী। সাদিফ সহজ,সাবলীল ভাবে হাতে নেয়। ছোট করে জানায়,

‘ থ্যাংক্স।’

তন্মধ্যে একটুও দেখলোনা চেয়ে। মৈত্রী আশাহত হলো। হাসিহাসি কোমল চেহারাটা মিইয়ে গেল। বললনা কিছু। সুধীর কদমে পূর্বের স্থানে ফিরে গেল পুনরায় ।

গ্লাসে চুমুক দিতে দিতেই হঠাৎ সিড়ির দিকে চোখ গেল সাদিফের। মারিয়া নামছে। হাতে এঁটো থালাবাটি। বর্ষাকে খাইয়ে কেবলই এলো। সে সরাসরি রান্নাঘরে ঢুকেছে। মেয়েটার কথাতো তার মাথাতেই ছিল না। পুরোনো প্রশ্নটা মনে জেগে উঠল আবার। এই উটকো ঝামেলা এখানে কেন? ভাইয়া এনেছেন? না না, ভাইয়া, মেয়েদের সাথে আনবেন না কী!

সাদিফ কাকে জিজ্ঞেস করবে বুঝে পেলোনা। পিউ,পুষ্প এদের কাছে জানতে চাইলে উল্টোপাল্টা ভাববে।সে আশেপাশে তাকাল।

তখনি ত্রস্ত ভঙিতে বাড়িতে ঢুকল বেলাল। কিচেনের দিক ছুটতে গেলেই পথ আগলে দাঁড়ায় সাদিফ। ছেলেটা থামল,ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

‘ কিছু বলবেন ভাইয়া? ভীষণ তাড়া আছে আমার।’

‘ কীসের তাড়া?’

‘ বাজি ফাটাব,ম্যাচ বক্স লাগবে। আমাদের গুলো শিশিরে ভিজে গেছে , জ্বল*ছেনা।’

‘ আচ্ছা যাবে, আগে বলোতো, ঐ কালো চুড়িদার পরা মেয়েটি কে?’

তার ইশারা করা দিকে তাকাল বেলাল। কাউকে দেখতে না পেয়ে বলে ‘ কোন মেয়ে?’

‘রান্নাঘরে দেখে এসো।’

বেলাল মাথা নাড়ল। রান্নাঘরে গিয়ে উঁকি দিলো। কালো জামায় শুধুমাত্র মারিয়াকে দেখেই আবার ফেরত এসে বলল,

‘ ওটাত মারিয়াপু।’

‘ নামটা আমিও জানি। কী হয় তোমাদের?’

‘ আপুর বেস্টফ্রেন্ড।’

সাদিফের ভ্রুঁ উঠে এলো। তব্দা খেয়ে বলল ‘ বর্ষার বেস্টফ্রেন্ড? মানে ওর সাথে পড়ে?’

‘ হ্যাঁ। কেন? ‘

সাদিফ নির্বোধ বনে থাকল কিছু সময়। এই মেয়ে বর্ষার বয়সী? অথচ তাকে বলেছে ধূসরের বন্ধু! তার মানে বড় সাজার নাটক,যাতে সে বোকার মত সন্মান দেয়? ভাগ্যিশ,সে তখন দমে যায়নি। নাহলে মেয়েটা কী মুরগীটাই না বানাত।

বেলাল সাদিফের ভাবুক চেহারা দেখল। ভ্রুঁ উঁচিয়ে দুষ্টমি করে বলল,

‘ আপনার কী আপুকে পছন্দ হয়েছে ভাইয়া?’

সাদিফ চোখ কূঁচকে তাকায়। প্রচন্ড অনীহ কণ্ঠে বলল,

‘ ছ্যা! আমার চয়েস অত বাজে নয়।’

বেলাল মুখ ছোট করে বলল,

‘ এভাবে বলছেন কেন? উনি কিন্তু আমার ক্রাশ।’

‘ তো আমি তোমাকে কখন বললাম, তোমার চয়েস ভালো?’

বেলাল বাচ্চাদের ন্যায় ঠোঁট ফোলায়। সাদিফ গভীর ভাবে ভেবে হঠাৎই বক্র হাসল । ওষ্ঠের এক পাশ সূচাল হলো। মনে মনে বলল,

‘ মিস ম্যালেরিয়া,বড় সেজে সন্মান নিতে চেয়েছিলেন তাইনা? এমন সন্মান দেব এবার।’

‘ আমি এখন যাই ভাইয়া?’

উত্তরে সাদিফ হেসে বেলালের কাঁধে হাত রাখল। ওকে আগলে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

‘ বেলাল,তোমাকে আমি আরো বাজি কিনে দেব। একটা কাজ করতে পারবে আমার?’

*****

ডেকোরেশনের সব কাজ শেষ। সবাইকে সাধ্যমতো বোঝানোর ইতি টেনেই পুরুষগণ বাড়িতে ঢুকলেন। ঠান্ডার মধ্যে এতক্ষন বাইরে থেকে গলা বসে গেছে আফতাবের। ফিরেই দু কাপ চা সাবাড় করেছেন। তাও কাজ হলোনা। এখনও ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজ বের হয়। আর যত বার কথা বলছেন,রুবায়দা বেগম হাসছেন ঠোঁট টিপে। মজা পাচ্ছেন তিনি। শেষ মেষ আফতাব গোঁ ধরলেন,গলা ঠিক না হওয়া অবধি টু শব্দ করবেন না। এই মহিলা ‘কথা বলো, কথা বলো’ করে কেঁ*দেকে*টে অজ্ঞান হলেও না।

সারাদিনের খাটুনি শেষে বিশ্রাম করতে গেলেন রাশিদ,আমজাদ,মুত্তালিব সবাই। অথচ গৃহীনিদের ছুটি নেই। আঁদা- রসুনের পর এবার চলছে মটরশুঁটি বাছাইয়ের কাজ। ময়মুনা খাতুনের খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। মিনা বেগমেরও একই অবস্থা। কিন্তু হাতের কাজ ফেলে যানই বা কী করে? সময় ওতো নেই। ও বাড়ি থেকে আবার বর্ষার কাপড়-চোপড় দিয়ে যাবে। বরের বাড়ির লোক যেহেতু,তাদেরও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করার ব্যাপার আছে।

এর মধ্যেই হাত প্লেট সাজিয়ে হাজির হলেন রুবায়দা বেগম। ওনার সাংঘাতিক বাতের ব্য*থা আছে। তাছাড়া বেশিক্ষন ঝুঁকে কাজ করতে পারেন না বলে কিছুতেই হাত ছোঁয়াতে দিলেন না মিনা বেগম। নিজেদের বাড়িও দিতে চাননা। এমনকি জবা সুমনাকেও না। তার বাপের বাড়ি বেড়াতে এসে জা’য়েরা খাটবে কেন? ওনারা অনেক জোড়াজুড়ি করেও লাভ হলনা। মিনা বেগম অটল। রুবায়দা এসেই লোকমা তুলে তার সামনে ধরে বললেন,

‘ এই নাও আপা,কাজ করতে করতে খেয়ে নাও দেখি।

মিনা বেগম চমকে গেলেন। আপ্লুত চোখে চাইলেন। পরপর হেসে মুখে নিলেন ভাত। রুবায়দা বেগম গেলেন ময়মুনা খাতুনের কাছে। একিরকম লোকমা তার মুখের সামনেও ধরলেন । তিনি মানা করলেন না। হেসে খেয়ে নিলেন। কাজে লেগে থাকা সবাইকে ঘুরে ঘুরে খাইয়ে দিলেন উনি। ভাত লাগলে আবার নিয়েও এলেন প্লেট ভরে। মিনা বেগম বললেন,

‘ এসবের কী দরকার ছিল বলতো মেজো।’

রুবায়দা বেগম হাত ধুঁয়ে এগিয়ে এলেন। নিঃসঙ্কোচে তার মুখটা মুছিয়ে দিতে দিতে বললেন,

‘ কোনও কাজ তো করতেই দিচ্ছোনা। এটুকু করলে কী হয়?’

মিনা বেগম ঠোঁট ভরে হাসলেন। এক হাত বাড়িয়ে বললেন ‘ আয় দেখি, একটু জড়িয়ে ধরি।’

রুবায়দা বেগম সাথে সাথে আকড়ে ধরলেন তাকে। জবা আর সুমনা মাত্র দাঁড়িয়েছেন এসে। এই দৃশ্যে দুজনেই ছুটে এলো। ওপর থেকে যে যেভাবে পারল একেকজন কে আগলে নিলো। চার জা’য়ের মেলবন্ধন দেখে উপস্থিত সবার মন -প্রান জুড়িয়ে যায়। শিউলী খাতুন ভীষণ বিস্ময় নিয়ে দেখলেন সব। আড়চোখে একবার তাকালেন ময়মুনার পানে। তিনিও তাকিয়েছেন তখন। সাথে সাথে মাথাটা নামিয়ে নিলেন শিউলি। তাদের দুই জায়ের মধ্যে এত মিল নেই। ধরাবাঁধা সবটাই। ময়মুনার থেকে তিনি উচ্চ বংশের বলে মনে মনে হিং*সে করতেন। দুরুত্ব রেখে চলতেন। কত বড় ভুলই না করেছেন। তার ননাসের সাথে জা’য়েদের কী মিল! কী সখ্যতা! এমন ভালোবাসা দেখলেও মনে শান্তি লাগে।

****

ধূসর খেয়ে বসেছে কেবল। সাদিফ ও উল্টোপাশে বসে ফোন বের করল। সারাদিনে সোস্যাল মিডিয়া ঘাঁটা হয়নি। দিনে হাজারখানেক ছবি তুলেছে সে। আপাতত ডিপি পালটাবে। সে ফেসবুক অন করতেই হুরহুরে নোটিফিকেশনে ভরে গেল। টুং টুং শব্দে বিরক্ত চোখে চাইল ধূসর।

‘ ফোন সাইলেন্ট কর।’

‘ করছি। ‘

আদেশ মানল সাদিফ। তারপর একে একে নোটিফিকেশন সব গুলো ঘাঁটল। নতুন দুটো ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট এসেছে। চেক করতেই দেখল ‘ অবন্তী নাজনিন মৈত্রী ‘ নাম দিয়ে এসেছে একটা। সাদিফ প্রোফাইলে ঢোকে মেয়েটির। আইডি দেখতে স্ক্রল করে। মৈত্রীর চেহারা দেখে চিনে ফেলল। এটাত ওরই তোলা ছবি। দুপুরেই তুলে দিলোনা? ক্যাপশনে চোখ যেতেই সাদিফের নেত্র ঘোলা হয়ে আসে।

‘ক্লিক: প্রিয় মানুষ ‘

সাদিফ তড়িঘড়ি করে ফোন থেকে চোখ তোলে। আশেপাশে তাকায়। মৈত্রীরা গল্পে বিভোর। সে তাকানো মাত্র আড়চোখে মেয়েটা তাকাল। সাদিফ ওমনি সরিয়ে আনল দৃষ্টি। ঢোক গিলল পরপর। এই মেয়ে কি তাকে নিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবছে? হায়! হায়! তাহলেত সর্বনা*শ!

বসার ঘর আপাতত ছোট দের দখলে। ওদিকে সাউন্ড সিস্টেমও বন্ধ। সারাদিনের ধকল শেষে জিরোচ্ছে। এর মধ্যেই বর্ষা সমেত ওপর থেকে নেমে এলো মারিয়া। প্রত্যেককে একবার একবার দেখে বলল,

‘ একী! বিয়ে বাড়ি এত নেতিয়ে থাকলে হয়! সবাই চুপ করে আছে কেন?’

সাদিফ ফোনের দিক চেয়ে আওড়াল ‘ তো কি বাঁদরের মত লাফাবে?’

মারিয়া নাক ফুলিয়ে বলল

‘ আমি কি আপনাকে বলেছি? আপনি কেন যেঁচে ঝ*গড়া করতে চাইছেন? ‘

সাদিফ তাকাল, টেনে টেনে বলল,

‘ না না আপু। কী যে বলেন! আপনি হলেন সন্মানীয় মুরব্বি। আপনার সাথে ঝ*গড়া করব আমি?

তারপর দুগালে দুটো থা*প্পড় দিয়ে বলল,

‘ তওবা তওবা।’

বর্ষা ওরা কিছুই বুঝলোনা। জিজ্ঞাসু চেহারায় তাকায় মারিয়ার দিকে ।

ধরা পরে যাওয়ার আশঙ্কায়, কথা কা*টাতে, সে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

‘ আব,বর্ষা, পুষ্প চলো আমরা সবাই মিলে ট্রুথ আর ডেয়ার খেলি।’

সুপ্তি লাফিয়ে ওঠে। এতক্ষন সে,শান্তা, মৈত্রী এক জায়গায় বসে গল্প করছিল। সেখান থেকে লম্বা পায়ে দৌড়ে আসে শুনেই । বর্ষা,সহ বাকীরাও হৈহৈ করল। পিউ দুরন্ত পায়ে নেমে এলো নীচে। স্ফূর্ত কণ্ঠে বলল,

‘ কী খেলবে সবাই? আমিও খেলব।’

‘ ট্রুথ ডেয়ার। ‘

‘ খেলব খেলব।’

বর্ষা বলল ‘ কিন্তু বসব কোথায়? ‘

‘ কেন? পাটিতে। ‘

শান্তা বলল ‘ আমি নিয়ে আসছি।’

মিনিটের মাথায় পাটি হাতে ছুটে এলো সে। বিছিয়ে দিলো ফ্লোরে। ওমনি হুটোপুটি করে বসে গেল সবাই। মাঝখানে বিশাল জায়গা রেখে গোলাকার বানাল। বর্ষা গলা একটু উঁচিয়ে বলল,

‘ আপনারা খেলবেন না ভাইয়া?’

পুষ্প, পিউয়ের কানের কাছে এসে বলল,

‘ বর্ষা জিজ্ঞেস করার লোক পেলোনা,ধূসর ভাই না কি খেলবে!’

তারপর দুবোন ঠোঁট চে*পে হাসল। যেন দারুণ কৌতুক শুনল আজ।

ধূসরের কোঁচকানো ভ্রুঁ,চোখ ফোনে নিবদ্ধ। উত্তর করল সাদিফ,বিরস কণ্ঠে বলল,

‘ বাচ্চাদের খেলা আমরা খেলিনা।’

মারিয়া মুখ ভ্যাঙ*চায়।

তখনি কোত্থেকে ছুটে এলেন আনিস, পেছনে সুমনা বেগম। রিক্তকে কেবল ঘুম পাড়িয়েই এলেন । তিনি হন্তদন্ত ভঙিতে বললেন,

‘ এই এই, কী করছিস রে তোরা?’

পুষ্প জবাব দেয়,

‘ ট্রুথ ডেয়ার খেলছি চাচ্চু।’

আনিস ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন ‘ সর সর বসি, আমিও খেলব।’

সবাই অবাক চোখে তাকাল। আনিস বসে পরলেন। সুমনা বেগমও বাবু হয়ে দখল করলেন জায়গা। পিউ ভ্রুঁ তুলে বলল,

‘ তুমিও খেলবে চাচ্চু?’

‘ অবশ্যই। আমি এখনও তরতাজা যুবক বুঝলি? বুড়ো হয়ে যাইনি। আমাকে তোরা তোদের টিমের ভাববি সবসময়।’

সুমনা বেগম বললেন, ‘ আর আমাকেও।’

আনিস নিষ্পৃহ কণ্ঠে প্রতিবাদ করলেন, ‘ এহ,এক বাচ্চার মা আবার যুবতি সাজে।’

সুমনা চেঁ*তে বললেন ‘ তুমি কী? তুমিও তো এক বাচ্চার বাপ।’

আনিস কলার ঝাঁকিয়ে জবাব দিলেন ‘ স্বর্ণের আংটি আবার বাঁকা!’

হুহা করে হেসে উঠল সকলে। পিউয়ের মনে চট করে উদয় হলো একটি নতুন ইচ্ছের। সে আস্তে-ধীরে উঠে ধূসরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। ছোট কণ্ঠে আবেদন করল,

‘ ধূসর ভাই,আসুন না খেলি…’

ধূসর তাকাল। চোখ সরু করে বলল ‘ তুই না একটু আগে কাঁ*দছিলি? ‘

পিউ ওমনি বত্রিশটা দাঁত বার করে বলল ‘ ওটাত অসুখে কেঁ*দেছি। কিন্তু এমন ওষুধ পেয়েছি সব অসু*খ সেড়ে গেছে। এখন আসুন না!’

ধূসর চোখমুখ গম্ভীর করে বলল,

‘ না।’

পিউয়ের আদল কালো হয়। পরপর সাদিক কে বলল ‘সাদিফ ভাইয়া আপনি ও খেলবেন না? ‘

সেও মাথা নাড়ল। তার দুটো কারণে আপত্তি। এক,মারিয়া প্রস্তাব করেছে। আর দ্বিতীয় মৈত্রী খেলছে। সাদিফের মন বলছে এই মেয়ের হাবভাব ভালো নয়। জল বেশিদূর গড়াতে দেয়া ঠিক হবে?

তখন আনিস বললেন,

‘ কেন রে? আয় সবাই মিলে খেলি,মজা হবে। ধূসর, সাদিফ চলে আয়। ইতিহাস রচনা করব আজ,ফাস্ট ছেলেরা।’

পিউ আবার আস্তে করে বলল ‘ ধূসর ভাই,প্লিইইজ।’

ধূসর দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফোন টিপতে থাকা হাতদুটো নিশ্চল হলো। উঠে দাঁড়াল। ফোন পকেটে ভরল। কোনও কথা না বলেই এসে বসে গেল আনিসের পাশ ঘেঁষে। হাসির প্রোকোপে পিউয়ের অধোর ফাঁকা হয়ে এলো। ধূসরকে বসতে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পরে শান্তা। একটু আগের হুম*কি মনে পড়ে যায়। কিশোরি মন দুলে উঠতে গিয়েও সহজ হলো। বাবা, মা কেউ জানলে জ্যান্ত কবর দেবে। থাক বাবা! দরকার নেই প্রেমের।

পিউ হূলস্থূল করে এসে আগের স্থানে বসল । ঠিক তার ধূসর ভাইয়ের সামনা- সামনি। সাদিফ মাথা চুল্কালো ধূসরকে যেতে দেখে। এবার নিজেরও ইচ্ছে করল খেলতে বসার। কিন্তু যে ভাব নিয়ে ছিল এতক্ষন, এখন যেঁচে উঠে গেলে ইগোটা কমে যাবে না? কেউত ডাকেওনা। তার উশখুশ বেড়ে আসে। বিড়বিড় করে বলে,

‘ কেউ ডাক,একবার ডাক,ডাক না রে!’

মৈত্রী তখনই মিহি কণ্ঠে বলল,

‘ আপনিও আসুন না। সবাই যখন বসল,আপনিই বা বাদ যাবেন কেন?’

অন্য সময় হলে শুনতোনা। ওই ক্যাপশন দেখেতো আরোই না। অথচ এখন ফটাফট উঠে দাঁড়াল সে।

চকচকে কণ্ঠে বলল ‘ সবাই এত করে যখন বলছে, তখন খেলি।’

মৈত্রী জায়গা দিলো,যাতে ওর পাশে বসে সাদিফ। কিন্তু সে খেয়াল অবধি করেনি। ঘুরে গিয়ে দাঁড়াল অন্য পাশে। পিউ,পুষ্প পাশাপাশি ছিল। সাদিফ পিউকে বলল ‘ বসব, সরে বোস। ‘

পিউ চোখ তুলে বলল ‘ কত জায়গা! এখানেই বসবেন?

‘ হ্যাঁ। এখানেই, আগা ওদিকে..’

পিউ কিছু বলল না। চুপচাপ সরে গেল। হঠাৎ খেয়াল হলো পুষ্প ছিল তার পাশে। সাদিফ ভাইয়া সরতে বলেছেন কি, আপুর পাশে বসবেন দেখে? সে দুষ্টু হেসে ভ্রুঁ নাঁচিয়ে নাঁচিয়ে বলল

‘ বুঝি,বুঝি সব বুঝি ভাইয়া।’

‘ কী বুঝেছিস?’

‘ এই যে,এখানে কেন বসলেন!’

সাদিফ অনিশ্চিত কণ্ঠে বলল ‘ আসলেই বুঝেছিস?’

পিউ কনফিডেন্স নিয়ে মাথা দোলায়। সাদিফ আরেকদিক চেয়ে হাসল। মৈত্রীর মন খা*রাপ হলো সে না বসায়। তবে একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে, সাদিফের সাথে পিউয়ের একটু বেশিই ভাব। লোকটাকে পেতে গেলে আগে ওকে ডিঙোতে হবে তাহলে?

সুপ্তি কোত্থেকে একটা কাঁচের বোতল জোগাড় করে এনে মারিয়ার হাতে দিলো। সে বোতল নিয়ে বলল,

‘ তাহলে এখন এটা এখানে রেখে ঘোরাব। যার দিকে যাবে প্রশ্ন তাকে করা হবে। ট্রুথ না ডেয়ার সেটা অবশ্যই যার যার পছন্দ। তবে হ্যাঁ, পরপর দুবার ট্রুথ নেয়া যাবে না। ‘

সাদিফ নিরস কন্ঠে বলল,

‘ এগুলো সবাই জানে। নতুন কিছু থাকলে বলুন নাহলে স্টার্ট দ্যা গেম।’

মারিয়া অসহ্য ভঙিতে তাকায়। সাদিফ সচেতন কণ্ঠে অবুঝ সেজে বলল ‘ এভাবে তাকাচ্ছেন কেন আপু? ছোট মানুষ, ভ*য় লাগে!’

মারিয়া ফের ভেঙচি কা*টে। সাদিফের গা জ্ব*লা কথাবার্তা ডাস্টবিনে ছু*ড়ে ফেলে আবার বলল ‘ প্রথমে কে ঘোরাবে?

আনিস উৎসাহ নিয়ে বললেন ‘ আমি,আমি।’

‘ আচ্ছা।’

এরপর বোতল ঠেলে দিলো ওনার দিকে। আনিস শার্টের হাতা গুটিয়ে প্রফুল্ল চিত্তে বোতলের এক প্রান্ত ধরে টান দিতেই ভোঁ ভোঁ করে ঘুরে ওঠে সেটি। সবাই ব্যগ্র হয়ে দেখতে থাকে। কার দিকে এসে থামবে কে জানে! একটা সময় ঘুরতে ঘুরতে এসে থামল বর্ষার সামনে। পিউ- পুষ্প সবাই হো হো বলে আনন্দধ্বনি তুলল। মৈত্রী বলল,

‘ বলো আপু, কী নেবে?’

বর্ষা হা করার আগেই বেলাল বলল

‘ কী আবার, ট্রুথ নেবে। ওর সাহস আছে না কী ডেয়ার নেওয়ার?’

বর্ষার ইগোতে লাগল। চোটপাট দেখিয়ে বলল,

‘ তুই আমাকে ভীতু ভাবিস? আমি মোটেও ভীতু নই।’

শান্তা বলল ‘ তাহলে ডেয়ার নাও?’

বর্ষা আগেপিছে না ভেবেই বলল,

‘ যাহ নিলাম। ‘

বেলাল এক হাত তুলে বলল ‘ আমি দেব ওকে ডেয়ার,আমি দেব।’

‘ আচ্ছা দাও,কিন্তু তাড়াতাড়ি। ‘

বেলাল একটু ভেবে বলল,

‘ যা,এই মুহুর্তে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করে আয়।’

বর্ষার চোখ বেরিয়ে রলো। আর্ত*নাদ করে বলল,

‘ কী,এখন?’

‘ হ্যাঁ। ‘

‘ অসম্ভব! অনেক ঠান্ডা আজ! এখন,এই রাতে কোন পাগল গোসল করবে?’

বেলাল কাঁধ উচু করে বলল,

‘সে আমি কী জানি? ডেয়ার নেয়ার আগে ভাবা উচিত ছিল। ফিল-আপ করতে পারিসনা,তাহলে খেলার জন্য লাফালি কেন?’

অপমানে বর্ষা থম ধরে বসে রইল কিছুক্ষন। এই কনকনে ঠান্ডায় দাঁতে দাঁতে বারি লাগে যেখানে সেখানে গায়ে পানি ঢালা? কাঁ*দোকাঁ*দো কণ্ঠে বলল,

‘ অন্য কিছু দেওয়া যায়না?’

বেলাল মাথা ঝাঁকায় ‘ না।’

‘ যাচ্ছি।’

মুখ ভার করে উঠে গেল সে। ও যেতেই

সবাই শব্দ করে হেসে ফেলল। বেলাল রাদিফকে বলল,

‘ যাও তো ভাইয়া, সত্যিই আপু গোসল করছে না কী দেখে এসো।’

গোয়েন্দাগিরি রাদিফের প্যাশন। বড় হলে ছোট চাচ্চুর মতন হবে সে। এক কথায় দুলতে দুলতে ছুটে গেল।

মারিয়া বলল,

‘ এমন ডেয়ার দিলে,বর্ষার তো আজ খবর হয়ে যাবে বেলাল।’

সাদিফ মনে মনে বলল ‘ একটু পর আপনারও হবে মাননীয় ম্যালেরিয়া আপু৷ অপেক্ষা করুন।’

বেলাল চুল ওপরে ঠেলে দেয়,একটু ভাব নিয়ে জানায়,

‘ সেদিন ঘুম থেকে উঠিনি বলে গায়ে পানি ঢেলে দিয়েছিল। আজকে প্রতিশো*ধ নিলাম।’

সুমনা বেগম চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,

‘ কিন্তু ওরতো ঠান্ডা লেগে যাবে।’

‘ আরে না আন্টি,ওর অভ্যেস আছে সন্ধ্যাবেলা গোসল করার। তাছাড়া গণ্ডারের সর্দি হয় দেখেছেন কখনও? ‘

‘ আচ্ছা বর্ষা আসুক,আমরা ততক্ষনে খেলতে থাকি।’

পুষ্পর কথায় সহমত পোষণ হয়। বোতল ঘোরাতে গেল সে, পিউ আবদার করল,

‘ আমি ঘোরাই?’

পুষ্প ওর দিকে ঠেলে দিয়ে বলল ‘ নে।’

পিউ উৎফুল্ল চিত্তে বোতলের শীর্ষ ধরে টানল। ঘুরল সেটা। কিন্তু শেষমেশ এসে ওর দিকেই থেমে গেল। পিউ নিরাশ কণ্ঠে বলল,

‘ যা বাবাহ! এত বেঈমা*নী! ‘

পূষ্প বলল ‘ বেশ হয়েছে!’

মারিয়া শুধাল ‘ বলো পিউ,কী নেবে?’

সুপ্তি পাশ থেকে বলে দেয়, ‘ ডেয়ার ডেয়ার! ‘

পিউ মাথা ঝাঁকাল,তবে সাবধান করল,

‘ আমাকে কিন্তু এই গোসল টোসলে জড়াবেনা কেউ। এখন গোসল করলে আপাতত তিন দিন বিছানা থেকে উঠতে পারব না কনফার্ম। ‘

বেলাল জানাল,

‘ আরে না পিউপু,এক ডেয়ার এক বারই। ‘

পিউ একটু স্বস্তি পেল। নিশ্চিন্ত কণ্ঠে বাছাই করল ‘তাহলে ডেয়ার।’

মৈত্রী সঙ্গে সঙ্গে বলল ‘ একটা গান গেয়ে শোনাও।’

পিউ চমকাল না। বরং অবাক হয়ে বলল ‘ গান?’

‘ হ্যাঁ। কতবার গুনগুন করতে শুনেছি। এবার পরিষ্কারভাবে শুনব, গাও। ‘

পিউ আড়চোখে একবার ধূসরের দিক তাকায়। তার শীর্ন চোখ এদিকেই। মানুষটার শ্যামলা চেহারা পিউয়ের প্রেম প্রেম উত্থলে আনে। অনুরাগের সাগরে ডু*বিয়ে দেয় মন। সে নিচের দিকে চোখ নামায়। শ্বাস টেনে ধাতস্থ হয়। মৃদূ কণ্ঠে গুনগুনিয়ে গেয়ে ওঠে,

(Don’t skip,enjoy with Piu)

❝ Agar tum mil jaoon

Zamaane chod denge hum.

Tumhe paaakar zamaane bhar se

Rishta tod denge hum.

Agar Tum Mil Jaoon,

Zamaane chod denge hum.

Bina tere Dilkash Nazara

Hum na dekhenge.

Tum he na ho pasand

Usko dobaraan hum na dekhenge

Teri suraat na ho zismein,

Woh,teri Surat na ho zismein,

O seeshan tod denge hum.❞

গানের প্রতিটি কথার নিবেদনে ধূসর ভাই। তাকে জুড়ে এর সমগ্র লাইন,সমস্ত বাক্য। সুরের মাধ্যমে সব ভালোবাসা,অনুভূতি তার পায়ে লুটিয়ে দিচ্ছে পিউ। কণ্ঠ ধীরে ধীরে জোড়াল হলো তার। গলা ছেড়ে বেরিয়ে আসে ধ্বনি। মাঝেমধ্যে অনুচিত নেত্রে দেখে নেয় সামনে বসা মানুষটিকে। আহ! তার প্রেমাসম্পদ। ধূসরের দৃষ্টি অবিচল। বিন্দুমাত্র নড়ন চড়ন নেই। এভাবে তাকিয়ে কেন উনি? কী দেখেন এত?

গান থামাতেই সবাই তালি বাজাল। পিউ আরেকবার নিভু চোখে তাকাল ধূসরের দিক। মানুষটা একিরকম বসে,ঠোঁটে হাসি নেই। অথচ জ্বলজ্বলে চোখ দুটো কী যেন বলছে!

তালি বর্ষন থামল। সবাই প্রসংশা করল। সাদিফ সাধুবাদ জানিয়ে বলল,

‘ তোর গানের গলা কিন্তু মাশ আল্লাহ!’

পিউ মৃদূ হাসে। লজ্জ্বা লজ্জ্বা পায়। ধূসর ভাইয়ের সামনে আজ প্রথম গান গাইল,কুন্ঠা হবেনা?

এর মধ্যে থরথর করে কাঁ*পতে কাঁ*পতে হাজির হলো বর্ষা। পা থেকে মাথা অবধি ঢাকা মোটা কম্বলে। ওকে দেখতেই আরো এক দফা রোল পরলো হাসির। রাদিফ সাথে এসে জানাল ‘ গোসল করেছে।’

মারিয়া পাশ দেখিয়ে উতলা কণ্ঠে বলল ‘ আয় আয় এখানে আয়। ‘

অথচ তার ঠোঁটেও চাপা হাসি। বর্ষা ভাইয়ের দিকে কিড়মিড়িয়ে তাকাতে তাকাতে বসল। বেলাল মিটিমিটি হাসছে। দারুন জব্দ করেছে এটাকে আজ।

সুমনা বেগম রসিকতা করে বললেন,

‘ তা বর্ষা, এত রাতে তোমার গোসলের অনুভূতি কী?’

সে অত্যন্ত দুঃ*খ নিয়ে বলল,

‘ আর বলবেন না আন্টি, পানি তো নয় যেন হিমালয়ের আইস বার। ‘

পরপর বেলালের দিক চেয়ে খরখরে কণ্ঠে বলল,

‘ তুই মনে রাখিস আজকের কথা। যদি তোকেও ফেরত না দিয়েছি এসব,দেখিস।’

বেলাল মশা তাড়ানোর মত হাত নেড়ে,হুম*কিটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিল। উলটে বাকীদের তাড়া দিয়ে বলল ‘ বসে আছি কেন? শুরু করো। ‘

মুহূর্তমধ্যে চকচকে বোতল আবার ঘোরানো হলো।

সাদিফ ঘুর্নায়মান সেটার দিক চেয়ে ফিসফিসিয়ে অনুরোধ করল,

‘ আমার দিকে আসিস না ভাই,একদম না।’

জড়বস্তু শুনে ফেলল তার আবেদন। বোতলের প্রান্ত গিয়ে থামল ধূসরের সামনে। পিউয়ের চেহারা চকচকে হয়ে ওঠে। সবাই হোওওও…. বলে ধ্বনি তোলে ফের। সকলে নড়েচড়ে বসল এবার ।ধূসরের মত পানসে, সিরিয়াস মানুষ আজ তাদের সাথেই খেলছে। আবার প্রশ্নের পালাও তার। আনিস আগ্রহ নিয়ে বললেন,

‘ বল ধূসর,কী নিবি?’

ধূসর হা করতে গেলেই মারিয়া বলে ওঠে,

‘ পরপর অনেক গুলো ডেয়ার গেলো,তুমি না হয় ট্রুথ নাও ভাইয়া!’

ধূসর মেনে নিল, ছোট করে বলল,

‘ ওকে।’

মারিয়া আরেকটু উৎফুল্ল হয়ে বসল। ঝরঝরে কন্ঠে শুধাল,

‘ আচ্ছা ভাইয়া,তুমিতো সারাক্ষন বাইরে থাকো,কাজ করো,এদিক ওদিক ছোটাছুটি করো। এত ব্যস্ততার মধ্যেও এমন কোন জিনিস, যেটা তোমাকে শান্তি দেয়,স্বস্তি দেয়। যেটা দেখলে মনে হয় যে, না আমার সব কষ্ট,সব ক্লান্তি শেষ?। ‘

সাদিফের প্রশ্ন পছন্দ হলোনা।

বিড়বিড় করল, ‘ বোকা বোকা প্রশ্ন।’

অন্যরা উৎসুক হয়ে তাকায় ধূসরের উত্তর জানতে। পিউ সবথেকে বেশি উৎকন্ঠিত। কী বলবে সে? ধূসর সকলের চাউনি উপেক্ষা করে চোখ নামাল মেঝেতে।

চলবে,….

  • নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top