পৃথিবীতে অজস্র রকমের অপরিপক্কতার মাঝে একটি বোধহয় ‘সিদ্ধান্তহীনতা’। এই অপরিপক্কতা শরীরের নয়, মনের এবং মস্তিষ্কের। জীবনের যেকোনো কঠিন থেকে কঠিন সময়গুলোতে, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার কারনে মানুষকে আজীবনের জন্য আফসোসের ভার বহন করে যেতে হয়। আমিও বোধহয় সেসবের উর্ধ্বে নই। লাইফের বিশেষ বিশেষ সময়গুলোতে আনি প্রচন্ড রকমের ডিসিশন ম্যাকিং ব্লকে ভুগেছি। মন আর মস্তিষ্কের দোটানায়, আমি সবসময়ই সিদ্ধান্তহীনতার মতোন সাংঘাতিক রোগের স্বীকার হয়েছি। আমি কখনোই পরিপূর্ণভাবে আমার মনের শুনিনি। আবার মস্তিকের বেলাতেও একি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছি। নিরপেক্ষতা দেখিয়েছি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলোতে। আজও তা-ই হলো। আমার ওকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলা উচিৎ ছিল “অভ্র, তুই থেকে যা প্লিজ” কিন্তু আমি আজও নির্বাক থেকেছি! অভ্রকে আমার আজও বলা হলো না “তোর প্রতি আমার অশেষ মায়া,অভ্র”
রাত ১০ টা
পুষ্পের দাদা বাড়িতে আজকেই আমাদের শেষ রাত। তা-ই ফ্রেন্ড রা মিলে আজ না ঘুমিয়ে ছাদে আড্ডা দেওয়ার লোভ টা কিছুতেই সামলাতে পারলামনা। আমাদের আড্ডা আরেকটু জমজমাট করতে, আন্টি আমাদের কয়েক রকমের ভাজাপোড়া নাশতা দিয়ে গেলেন।
-আমার মতো অভাগা পৃথিবীতে বোধহয় একটা-ই আছে রে! (শব্দ করে শ্বাস ফেলে)
সিফাতের কথায় আমরা সকলে হতচকিত চেহারায় তাকালাম। রুম্পা ভ্রু কুঁচকে শুধালো-
-তোর আবার কি হলো?
-কি হয়নাই? আমার জীবনের দুঃখ শুনলে বড় বড় কবি, সাহিত্যিকরাও মাথায় হাত দিয়া ভাববো, “এতোদিন কী ট্রাজেডি লিখলাম,আসল ট্রাজেডি তো সিফাতের জীবন থেকে নেওয়া দরকার ছিল!”
মেঘা চ সূচক শব্দ করে বললো-
-নাটক না করে বলবি কি হইসে?
-তোরা জাস্ট মেনিফেস্ট কর, পুষ্প একটু পরে বাশর ঘরে ঢুকবো! ভাবতেই কেমন আত্না কেঁপে উঠতেসে আমার! আমার মতোন ড্যাশিং,হ্যান্ডসাম বয় বাদ রাইখা পুষ্প আস্ত এক উগান্ডা বিয়ে করে ফেললো! ভাবা যায়??
মেঘা জবাবে বললো-
-হ্যা সেটাই তো, তোর মতোন অতি গুনধর পাত্র রাইখা এমন কালাচাঁদ বিয়া করা পুষ্পের মোটেও ঠিক হয়নাই। আমি পরিপূর্ণভাবে এইটার বিরোধিতা করতেছি দোস্ত। দিস ইজ ভেরি ব্যাড! এতো আশ্চর্যজনক ঘটনা জনমানব কে না জানানো টাও অপরাধের কাতারেই পরে। আমাদের আসলে গণমাধ্যমকে বিষয়টা অবগত করা উচিৎ।
জাহিদ সহমত পোষণ করে বললো-
-ঠিক কইছোস। জাস্ট ইমাজিন কর, কালকে ব্রেকিং নিউজের শিরোনামে লেখা থাকবে “প্রেমের টানে উগান্ডা থেকে ছুটে আসলো প্রেমিক,ভেঙে খানখান করে দিল সিফাত নামের এক প্রেমিক পুরুষের হৃদয় ” ওয়াও! এক নিউজেই সিফাত হয়ে উঠবে টপ টপিক অফ দ্যা কান্ট্রি।
রুম্পা বললো-
-পার্ফেক্ট। বাট দোস্ত এনাদার থিং ইজ, সে-ই নিউজে সাদিয়ার কোনো রোল থাকবে না?
মেঘা বেশ সিরিয়াস মুখভঙ্গি করে বললো-
-অবশ্যই থাকবে। এই নিউজ পাবলিশ্ড হওয়ার পরপরই আমরা আরেকটা প্রেজেন্টেশন দেখতে পাবো। যেমন ” ব্রেকিং নিউজ, প্রিয় দর্শক, কিছুক্ষণ আগে সিফাত নামের যে-ই যুবকের খানখান হওয়া হৃদয়ের গল্প টা শুনছিলেন?এই মুহূর্তে তাঁর হৃদয় খানখান+খানখান= ডাবল খানখানে পরিনত হয়েছে। কারন জানতে চান? তাহলে চিনে রাখুন এই মহীয়সী নারীকে।উনি সিফাতের বর্তমান প্রেমিকা। আমাদের নিউজ টা দেখার পর তিনি, সিফাতের খানখান হওয়া হৃদয় বুক থেকে বের করে কিছুক্ষণ ফুটবল খেললো,তারপর হাডুডু, তারপর ক্রিকেট। এভাবে খেলতে খেলতে দ্বিতীয় দফায় সিফাতের হৃদয় টা খানখান থেকে ডাবল খানখনে পরিনত করে ফেললো”
মেঘার কথায় আমরা ফিক করে হেঁসে ফেললাম। সিফাত কাঁদোকাঁদো স্বরে বললো-
-আপনা টাইম আয়েগা।
আমাদের আড্ডার মাঝে অভ্র কোনো কথাই বললো না। এমনকি আমাদের থেকে বেশ দূরত্ব নিয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। অভ্রকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি মেঘার কানে ফিসফিস করে বললাম –
-অভ্রকে বল এখানে আসতে। কালকের ট্রিপের প্ল্যানিং করতে হবে না?
আমার কথা শোনার পরই সকলের কালকের ট্রিপ নিয়ে চিন্তা হতে লাগলো। সিফাত চিন্তিত স্বরে বললো-
-বন্ধু কালকে কিভাবে কি করবো, প্ল্যানিং করসো?
-প্ল্যানিং করার কি আছে? আমাকে ফলো করবি শুধু(অভ্রের সংক্ষেপে জবাব)
-তুই এখানে আসতে পারছিস না? একা একা দাঁড়িয়ে কি এমন ভাবছিস? বিয়েসাদী, বাচ্চাকাচ্চার প্ল্যানিং একা একাই করে ফেলবি নাকি?
রুম্পার কথার কোনো জবাব দিল না অভ্র। চুপচাপ এসে আমার পাশেই বসলো।
-হুম বল কেমন প্ল্যান শুনতে চাস?
জাহিদ বললো-
-তুই যেভাবে প্ল্যান করেছিস ওইটাই বল।
আমরা সকলেই গভীর মনোযোগ নিয়ে বসলাম এবার। দশ সেকেন্ড কিছু একটা ভেবে অভ্র বলা শুরু করলো-
-শোন,আমরা মূলত দুইটা স্পটে ঘুরবো। প্রথমে বিছানাকান্দি আর তারপর পান্থুমাই ঝড়নায়। আমাদের ট্রিপ টা যেহেতু একদিনের তাই আমি চব্বিশ ঘণ্টার জন্যই একটা হোটেল বুক করেছি। আগামীকাল ভোরেই আমরা সেখানে উঠবো। তারপর সকালের নাস্তা শেষ করে লেগুনা করে পীরের বাজারে যাবো। ওখান থেকেই মূলতঃ বিছানাকান্দি যাওয়ার ট্রলার পাওয়া যায়। বিছানাকান্দি পৌঁছাতে পৌছাঁতে আমাদের বোধহয় এগারোটা বাজবে। এই স্পটের সৌন্দর্য সম্পর্কে এতো ডিটেইলস বলতে পারবোনা। তবে তোরা(মেঘা,রুম্পা,মিতু) যেহেতু আগে কোথাউ যাসনাই তোদের কাছে হুমকি খেয়ে পরার মতোই সুন্দর লাগবে। তোরা গেলেই বুঝতে পারবি।
কিছুক্ষণ থেমে
-তারপর এখানে দুই আড়াই ঘন্টা থাকার পর, এখানেই খাওয়ার জন্য হোটেল রয়েছে, সেখানে লাঞ্চ করবো। তারপর একি ট্রলারে করে যাবো পান্থুমাই ঝরনায়। পান্থুমাই থেকে ফিরতে ফিরতে হয়তো আমাদের রাত হয়ে যাবে। আপাততঃ এই পর্যন্তই থাক। বাকিটা গেলেই জানতে পারবি।
আমরা সকলে মনোযোগ দিয়ে এতোক্ষণ শুনছিলাম। যেহেতু আমি, রুম্পা,মেঘা আগে কখোনোই যাইনি তা-ই এই সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করারও প্রয়োজন বোধ করলামনা।
অভ্রের কথা শেষ হতেই কিছু একটা চিন্তা করে জাহিদ অসন্তুষ্ট হওয়ার স্বরে বললো-
-অভ্র, এতো বেস্ট দুইটা স্পটের বর্ননা তুই এতো সাদামাটাভাবে দিলি? তোর মধ্যে কি কোনো অনুভুতি নাই রে ভাই? তুই তো পাঁচ ভাগও বলতে পারতি,ওরা আরেকটু এক্সাইটেড হইতো। যাওয়ার পর নায়হয় বাকি পঁচানব্বই ভাগ উপলব্ধি করবো।
অভ্র মুখের গাম্ভীর্যতা ধরে বললো-
-গেলেই তো দেখতে পাবে। এতো কাহিনি করে বলার প্রয়োজন নাই।
আড্ডা শেষে সকলেই রুমে ফিরে গেলো। গেলামনা শুধু আমি। ইচ্ছে হলোনা যেতে। কিছু কিছু সময় থাকে যখন মানুষের শুধু নিজের সঙ্গই স্বস্তিদায়ক বলে মনে হয়।
গভীর রাত। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। আজকের রাতটা কেমন মন খারাপের রাত বলে মনে হতে লাগলো আমার! এই খোলা আকাশের নিচে একাকী দাঁড়িয়ে আমি। অবশ্য একা বললে ভুল হবে। কারন আমাকে এই মুহূর্তে একা থাকতে দেওয়ার মতোন উদার মন বোধহয় রুপকুমারী চাঁদের নেই। কেমন ড্যাবড্যাব চোখ করে লজ্জাহীন নববধূর ন্যায় সে চেয়ে আছে আমার মুখপানে। তার সাথে সঙ্গ দিল বাঁচাল ঝিঁঝি পোকাদের দলেরাও। ওরা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে চাইলো। আমি ওদের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। তারপর অভিমানী মুখ করে বলে উঠলাম-
-একদম ছোঁবে না আমায়!
ওরা মৃদু হেঁসে শুধালো-
-মন খারাপ?
আমি কোনো জবাব দিলাম না। শব্দ করে নিশ্বাস ফেললাম। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ওরা আবার প্রশ্ন করলো-
-ভালোবাসো তাকে?
আমি নিচু স্বরে জবাব দিলাম-
-জানিনা।
-তাহলে তোমার চোখে পানি কেনো?
হঠাৎ কারোর পায়ের শব্দে ওরা নিজেদের গুটিয়ে নিল। আমি তখনো পূর্বের ন্যায় দাঁড়িয়ে। পেছন ফিরে তাকালামনা। অজ্ঞাত মানুষটির পায়ের শব্দ আমার পরিচিত। তার আগমনে আমার অভিমানেরা এবার যেনো আকাশ ছোঁয়াল। আমি স্পষ্ট তার নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম। তবুও পাশ ফিরে তাকালাম না। বেশ অনেকক্ষণ দু’জনেই চুপ রইলাম। এই গভীর রাতেও তার তীক্ষ্ণ চোখ আমায় বিব্রত করতে এক রত্তিও ছাড়লো না। কেমন নির্লজ্জের মতোন চেয়ে রইলো পলকহীন দৃষ্টিতে!
-ঘুমাসনি?
অভ্র জবাব দিল না। আমি অভিমানী স্বরে বললাম-
-এভাবে তাকিয়ে থাকবি না। অস্বস্তি লাগে আমার।
-লাগুক
কিছুক্ষণ পিনপতন নিরবতা।
-কেঁদেছিস কেনো?
-কোথায়? ভুল দেখেছিস,বোধহয় চোখে কিছু একটা পরেছে।
-তোকে তোর চেয়েও বেশি যে জানে,তোর চোখের প্রতিটি ঝলকানির ভাষা যে পড়তে জানে,তার কাছে মিথ্যে বলার দুঃসাহস দেখাবি না, মিতু।
আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওর চোখের দিকে তাকালাম। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম-
-আব্বু যদি মেনে নেয়? কি করবো আমি?
আমি এমন কিছু বললো, অভ্র হয়তো আশা করেনি। কেমন বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো আমার মুখে। তারপর মৃদু হেঁসে জবাব শুধালো –
-ভালোবাসিস আমায়?
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিলাম-
-জানিনা।
অভ্র মুখে মিছিমিছি গাম্ভীর্যতা একে বললো-
-তাহলে আর এতো চিন্তা কিসের? ভালো না বাসলে এটার সমাপ্তি এখানেই হয়ে যাক। বাপ পরযন্ত যাওয়ার কোনো প্রয়োজন দেখছিনা।
ওর কথা শোনামাত্রই আমার বুকের ভেতরটায় ঝর বইতে শুরু করলো। আমি টলমল চোখে কিছুক্ষণ ওর মুখের চেয়ে থাকলাম। অভ্র প্রতিক্রিয়া না দেখার ভান করে মুখে শিশ বাজাতে লাগলো। রাগে, দুঃখে ওকে খু*ন করে ফেলতে ইচ্ছে হলো আমার। পাষান পুরুষ একটা!
-কি সমস্যা? এভাবে তাকাবি না আমার দিকে। আমার দিকে এভাবে তাকানোর অধিকার শুধু আমার ভবিষ্যত বউয়ের আছে। পরপুরুষের দিকে এভাবে তাকাতে হয়না, চোখ সরা।
আমি জবাব দিলাম না। প্রকট রাগ দেখিয়ে হনহনিয়ে চলে যেতে নিলেই অভ্র আমার হাত টেনে ধরলো। তারপর হেঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে এনে, ধনুক চোখে চেয়ে থেকে বললো-
-ভালোবাসিস কি না? আমি ইয়েস অর নো শুনতে চাই,মিতু।
-যদি জবাব টা সঠিক সময়ের জন্য তোলা রাখি?
-সে দিনটা কবে আসবে,ম্যাডাম?(আমার দুই কাঁধে নিজের হাত রেখে মাথা নিচু করে)
-যেদিন তোর মায়ের পাগলাটে ছেলে, অভ্রের বউ হতে পারবো।
আমার আকষ্মিক কথায় অভ্র বোধহয় অপ্রস্তুত হয়ে পরলো কিছুটা। ওকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আমি বললাম-
-বিশ্বাস হচ্ছে না?
ও মাথা বামডান দুলিয়ে বোঝালে, ওর বিশ্বাস হচ্ছে না।
আমি মৃদু হাসলাম। অভ্র পূনরায় আদুরে কন্ঠে শুধালো –
-মিতু।
-হু
-যদি এই অনুভূতি তোর পক্ষ থেকেও একই হয়,তাহলে জেনে রাখ সৃষ্টিকর্তা ব্যতিত কারো সাধ্য নেই তোকে অভ্রের থেকে কেরে নেওয়ার।
আমি এবারো জবাব দিলাম না। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমার পাগলাটে পুরুষের মুখপানে! সে-ও একইরকম কিংবা তার চেয়ে বেশি মুগ্ধতা নিয়ে চেয়ে রইলো আমার টলমটলে চোখে! আমার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। তার তীক্ষ্ণ চোখে তা বোধহয় এড়িয়ে গেলো না। আমার চোখের বর্ষন সইতে পারলোনা তার ওষ্ঠদ্বয়েরাও! কেমন কোমল স্পর্শে নিজেদের অস্তিত্ব বসিয়ে দিল আমার অক্ষুদ্বয়ে! আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেলো আমার নয়ন জোড়া। কেমন লজ্জাহীনভাবে প্রশ্রয় দিলো তাদের উষ্ণ স্পর্শ! ব্যাস,আমি মিয়িয়ে গেলাম! এবার সে-ই উন্মাদ পুরুষ তার শক্তপোক্ত পুরুষালি হাত দিয়ে আলতো করে আমায় জড়িয়ে ধরলো! তারপর আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললো-
-আই লাইক টু ফিল ইউর এক্সজিসটেন্স, ডার্লিং! লেট মে ফিল ইট ফরএভার!
তার উষ্ণ আলিঙ্গনে ক্ষনিকের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেললাম আমি! উপলব্ধি করলাম তার প্রতি আমার ব্যাকুল প্রেম!
চলবে…….