নবোঢ়া [পর্ব ৪৯ শেষ অংশ]

বিবাহানুষ্ঠানটি প্রাথমিকভাবে সেই সপ্তাহের শুক্রবার নির্ধারিত থাকলেও পরবর্তীতে পারিবারিক মশোয়ারায়, সবার সম্মতিতে অনুষ্ঠানটা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জমিদারবাড়ির একমাত্র ছেলে, একমাত্র উত্তরাধিকারী, তার বিয়ে তো আর সাধারণ রীতিতে হতে পারে না। এমন পবিত্র মিলন মহাসমারোহে, জমকালো আয়োজনে না হলে বংশের মর্যাদার অমর্যাদা করা হবে। উৎসবের ঢেউ লাগবে চারদিকে, সর্বত্র আলোর মেলা, সুরের ধারা, অতিথিদের ভিড়ে গিজগিজ, আর গ্রামের মানুষের চোখে বিস্ময় আর প্রশংসার দ্যুতি থাকবে তবেই না তাদের জৌলুস সবার সামনে ফুটে উঠবে। তাছাড়া গুলনূরও নিজের লজ্জা-সংকোচের খোলস ভেঙে লিখে জানিয়েছে, সে চায় শ্বশুরবাড়িতে পালকিতে চড়ে পৌঁছাতে। ছোটবেলায় যখনই কোনো বিয়ের শোভাযাত্রা গ্রামে ঢুকত, কাঁচা রাস্তায় তাল মিলিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসত পালকিবেহারারা, তখন সে স্বপ্ন দেখত, একদিন সেও এভাবেই পালকির দোলায় চড়ে শ্বশুরালয়ে পৌঁছাবে। যদিও তাদের দুজনের মতে এই বিয়ে প্রেমের নয়, সামাজিক দায়ে দুজনে বন্ধুত্বকে দাম্পত্যের বাঁধনে পরিণত করছে; তবুও গুলনূরের সেই আকাঙ্ক্ষাটুকু পূরণ করার জন্য জাওয়াদ মনের ভেতর তাগিদ অনুভব করে। সুফিয়ানের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়, বিয়ের আগের দিন গুলনূরকে দুই গ্রাম দূরের ভূঁইয়াদের পুরানো বাংলোবাড়িতে পাঠানো হবে। সেখানে হবে তার সাজগোজের পালা। নতুন শাড়ি-গহনা পরিয়ে, চোখে সুরমা দিয়ে, হাতে মেহেদি এঁকে সাজিয়ে তোলা হবে তাকে। পরদিন জাওয়াদ নিজে যাবে পালকিবেহারাদের নিয়ে। সেখান থেকে গুলনূরকে তুলে নিয়ে আসবে এই মহলে। তারপর শুরু হবে আসল উৎসব। সবার সামনে তারা স্বামী-স্ত্রী হবে। রাত জেগে চলবে খানাপিনা। বাজবে ঢোল-তবলা, গাওয়া হবে বিয়ের গান। ইতিমধ্যে অর্ধেক দাসীদের বাংলো বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, গুলনূরের সাজসজ্জা, খাওয়াদাওয়া আর আরামআয়েশের যেন সামান্যতম ত্রুটি না হয়।
মধ্য দুপুরের সূর্যটা কিঞ্চিৎ পশ্চিম আকাশে হেলতে শুরু করেছে তখন। বাতাসে আগুনের হলকা। এদিকে বিয়ের বাকি আর মাত্র তিন দিন। গোটা বাড়িজুড়ে এমন হুড়োহুড়ি যে বোঝাই যাচ্ছে না এই বিয়েতে আসলে কারো মনের সায় ছিল না। জোর করেই সবার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই আয়োজনের ভার। উঠান থেকে বারান্দা, গোয়ালঘরের আড়াল পর্যন্ত সর্বত্র একই ব্যস্ততার ছোটাছুটি। ঘরগুলো নতুন চুনকামে ঝকঝকে। রঙিন পর্দায় সাজানো জানালা। প্রতিটি হারিকেনে তেল ভরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। বারান্দার খুঁটিতে কাগজের মালা। কাঠের মেঝেতে এখনও কাঁচা রঙের গন্ধ। রান্নাঘরের পাশে বাঁশের অস্থায়ী চুল্লিতে দাউদাউ আগুন। খাসি-গরু থেকে শুরু করে ঘি-চিনি সব সংগ্রহ সম্পন্ন। দাসীরা ব্যস্ত চাপাটি-পিঠা-সন্দেশ বানাতে। নিমন্ত্রণপত্র পৌঁছে গেছে দূর-দূরান্তে। বিশেষ অতিথিদের জন্য প্রস্তুত লাল চাদরের বিছানা। পুরনো পালকি সেজেছে জরির মখমলে। পালকিবেহারাদের দেওয়া হয়েছে নতুন পোশাক। ঘোড়ার গলায় ঝুলছে ঘণ্টা। বাউল দল এসে উঠেছে অতিথি ভবনে। সারাদিন চলছে গানের রিহার্সাল। ঢোল-বাঁশি-দোতারা সাজানো প্যান্ডেলের কাছে। আগামীকাল আসছে পুতুলনাচের দল। এত আয়োজনের মাঝে প্রতিদিন ভিড় জমাচ্ছে গ্রামের মানুষ। তারা দেখছে জমিদারবাড়ির ঐশ্বর্য, আর গল্প করছে দাসী গুলনূরের ভাগ্য ফেরার কাহিনী।
এত কোলাহলের মধ্যেও সুফিয়ান ভূঁইয়া ভুলে যাননি নিজের দায়িত্ব। বাড়ির আঙিনার বারান্দায় বসে দুই কৃষকের বিবাদের সালিশ করছেন। কণ্ঠে তার ন্যায়ের সুষমা। দূর থেকে দৃশ্যটি পর্যবেক্ষণ করছে জুলফা, কোহিনূর, ললিতা ও দাস-দাসীরা। তাদের চোখে কৌতূহল। কারও হাতে তালপাখা, কারও ভ্রু একটু কুঁচকে আছে। পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে তারা বিচারের গতিপ্রকৃতি বুঝতে চাইছে।
সুফিয়ানের ডানে শব্দর, বামে বসা নাভেদ, মুখ থমথমে, চোখে বিরক্তির আগুন। সালিশ চলার মাঝেই বারবার ত্রাসের মতো হানা দিচ্ছে তিনটি কুকুরের চিৎকার। মনির আর সিদ্দিক হুংকার দিয়ে কুকুরগুলোকে তাড়ানোর চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ শান্তি মিললেও ফের শুরু হয় সেই ঘেউ ঘেউ আর লাফঝাঁপ। বিচার শেষে সুফিয়ান ধীরে ধীরে চোখ থেকে চশমা খুলে কাচটা রুমালে মুছে আবার পরে চোখ সরু করে তাকিয়ে সিদ্দিককে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি ব্যাপার? এত হুলস্থুল কেন ওদের মধ্যে?’
সিদ্দিক আঙুল তুলে বলে, ‘হুজুর, ওই যে ওখানে রাজা আগে লাল কুকুরটাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াত। কয়দিন ধরে লালটা সাদা ডোরাকাটা কুকুরটার সঙ্গে ঘোরাফেরা করছে। তারপর থেকে শুরু এক নারীকে ঘিরে দুই পুরুষের বিবাদ! হা হা হা।’
সিদ্দিক হেসে উঠে নিজের কথায়, যেন কত বড় রসিকতা করে ফেলেছে। যখন দেখে আশপাশের কেউ না হেসে চুপচাপ তাকিয়ে আছে, সে তাড়াতাড়ি মুখটা গম্ভীর করে ফেলে। যেন কিছুই উচ্চারণ করেনি, যেন সেও সবার মতোই বিরক্ত ওই যৌবনদীপ্ত সূর্যের দাহে! আর কোনো কিছুতেই যায় আসে না তার।
সুফিয়ান কুকুরের প্রসঙ্গে কথা বলায় অনীহা প্রকাশ করে নাভেদ ও শব্দরের দিকে ফিরে বলেন, ‘তোমরা এসো, আমি আড়তে যাচ্ছি।’
নাভেদ তৎক্ষণাৎ পিছু নিলেও শব্দর ধীরে ধীরে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখতে থাকে, কোথাও কোনো ত্রুটি আছে কিনা। প্রতিটি কোণায় নজর বুলায়, প্রতিটি আয়োজনের খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে। বিয়ের আয়োজনে সবকিছু ঠিকঠাক হচ্ছে তো? এই চিন্তা তাকে অস্থির করে রেখেছে কয়েকদিন ধরে। সব দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে নিশ্চিত হওয়ার পর সে মহলের দিকে এগিয়ে যায় পোশাক পাল্টাতে।
জুলফার ঘরটা জানালা দিয়ে আসা আলোয় আলোকিত। সে বসে আছে জানালার পাশের ছোট্ট টুলটায়। সামনে ছড়ানো তুষারসাদা একটা কাপড়, যার উপর রঙিন সুতোর কাজ চলছে। তার দক্ষ আঙুলগুলো সুঁইয়ের সাথে তাল মিলিয়ে একটা বেহালার চিত্র ফুটিয়ে তুলার চেষ্টায় ব্যস্ত। এই কাপড় দিয়ে নাভেদের জন্য তৈরি হবে ফতুয়া। পিঠের অংশে থাকবে তার প্রেম আর যত্নের ছোঁয়ায় তৈরি বেহালার এই অপরূপ সুন্দর নকশাটি। কল্পনা করতেই তার বুকে আনন্দ কলকল করে উঠছে। নাভেদ আর তার মধ্যে এখন আর কথার প্রয়োজন হয় না। চোখের ইশারায়, মুখের ভাবে বুঝে নেয় একে অপরকে। চাঁদের কুটি গ্রামের খেজুর বাগানের নিবিড় ছায়ায়, নির্জন বনপথের গহন অন্ধকারে, কিংবা নদীর মধুর কলতানের সাথে মিশে তাদের হয় গোপন দেখা। নাভেদের বুকে মাথা রেখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় জুলফা। কত রঙিন স্বপ্নের গল্প, কত অবাক কল্পনার জাল বোনে। দুজনে খুনসুটি করে, হাসিঠাট্টায় মেতে ওঠে। তাদের এই নিভৃত প্রেমের একমাত্র সাক্ষী হয়ে আছে বিশ্বস্ত শঙ্খিনী আর নীরব সেলিম। শঙ্খিনীর আনুগত্য প্রশংসার যোগ্য। জুলফা তার পরিবারের যাবতীয় খরচের দায়িত্ব নিয়েছে স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে। দরিদ্র পরিবারটির খাওয়া-পরা, থাকার ব্যবস্থার ভার নিয়েছে কাঁধে। বিনিময়ে শঙ্খিনী তার জীবন পণ করে রক্ষা করতে প্রস্তুত জুলফার প্রতিটি গোপনীয়তা। নিজের অস্তিত্ব উৎসর্গ করেছে প্রিয় প্রভুর সেবায়। হঠাৎ করেই শব্দরের পদচিহ্নের শব্দ ভেসে আসে বারান্দা থেকে। শঙ্খিনীর বুকে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়। আতঙ্কে দ্রুত পায়ে ছুটে গিয়ে জুলফাকে বলে, ‘বেগম সাহেবা, হুজুর আসছেন।’
জুলফার হাত কেঁপে ওঠে। তাড়াহুড়ো করে কাপড়টা লুকিয়ে ফেলে আলমারির গোপন কোণে। শঙ্খিনীও বাতাসের বেগে উধাও হয়ে যায় ঘর থেকে।
শব্দর যখন ঘরে প্রবেশ করে তখন তার দৃষ্টিগোচর হয় অক্ষত মোড়কটি। কলকাতার বিখ্যাত দোকান থেকে জাওয়াদের বিয়ে উপলক্ষে কিনে আনা দামি শাড়িটা এখনও অস্পৃশ্য হয়ে পড়ে আছে। তার মনে একটা তিক্ততা জেগে ওঠে। জুলফার দিকে তাকিয়ে বেদনা ভরা কণ্ঠে বলে, ‘শাড়িটা এখনও দেখোনি?’
জুলফা তখন তার লম্বা রেশমি চুলে আস্তে আস্তে চিরুনি বুলাচ্ছে। মুখ তুলে সে বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞেস করে, ‘কোনটা?’ যেন সত্যিই তার মনে নেই।
শব্দর নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে চোখে-মুখে হতাশার ছায়া নিয়ে। জুলফা একটু নড়েচড়ে বসে চিন্তা করে বলে, ‘ওহ, বিয়ের দিন তো পরবই। তখনই না হয় খুলব। এখন খোলার কী দরকার?’
শব্দর কোনো উত্তর খুঁজে পায় না। মুখে যেন ভাষা আটকে গেছে। সে আশা করেছিল আনন্দে জুলফার চোখ উজ্জ্বল হবে… উৎসাহে জড়িয়ে ধরবে, কৌতূহল ভরে শাড়ির রং দেখে মুগ্ধ হবে! অবশ্য জুলফার কাছ থেকে কখনোই সে সেই কাঙ্ক্ষিত সাড়া পায়নি। বরং গত কয়েকটা দিন ধরে তার মনে হচ্ছে জুলফা আরও বেশি উদাসীন হয়ে উঠেছে, আরও বেশি ব্যবধান সৃষ্টি করেছে তাদের মাঝে। হঠাৎ করেই তার মনের গভীর থেকে একটা আক্ষেপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। জুলফা যে তাকে বিয়ে করাতে সম্মত নয় সেটা সে জানত, তবুও বিয়েটা ভেঙে দেয়নি। ভেবেছিল, বিয়ে হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। কয়টা মেয়ে পছন্দমতো বিয়ে করে? বরং অধিকাংশ মেয়েই তো বিয়ের আগে বরের মুখও দেখে না। পরে তো ঠিকই কোনো অদৃশ্য মায়ার জালে আবদ্ধ হয়ে ভালোবেসে ফেলে সংসারকে, স্বামীকে। জুলফা কেন সেই মায়ার স্পর্শ পেল না?
জুলফা বিছানার চাদর সোজা করছে। সুন্দরভাবে সাজানো কাপড়চোপড় তুলে আবার যত্নে গুছিয়ে রাখছে। এই অযৌক্তিক ব্যস্ততার আড়ালে ঢাকার চেষ্টা করছে তার অস্বস্তি। শব্দর গভীর নিঃশ্বাস ফেলে পোশাক বদলে বেরোনোর প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তাড়াতাড়ি আড়তে পৌঁছাতে হবে।
শব্দরকে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিতে দেখে জুলফা স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। মানুষটার উপস্থিতিতে তার বুকের ভেতর একটা অস্বস্তি নদীর জলের মতো কুলকুল করে। হঠাৎ শব্দরকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে জুলফা পিছিয়ে যায়। ভাবে, হয়তো তাকে আদর করবে, বুকে টেনে নেবে কিংবা চুমু দেবে। এই ভাবনায় সে নিজেকে সঙ্কুচিত করে নেয়। কিন্তু এর কিছুই ঘটে না। শব্দর তার চুল থেকে একটি ধুলোর কণা সরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে বিদায় নেয় নীরবে।
সন্ধ্যার সোনালি আলো যখন ধীরে ধীরে নিভে যায়, সূর্য পশ্চিমের আকাশে রক্তিম রেখা এঁকে বিদায় নেয়। তারপরই আকাশের বিশাল পর্দায় ছড়িয়ে পড়ে অসংখ্য মুক্তোর মতো তারা। সেই তারকাখচিত রাতের আঁচল তলে, বারান্দার একপাশে একা বসে আছেন ললিতা। চারপাশে আলো-আবহে সাজানো উৎসবের আয়োজন; বাদ্যবাজনায় মুখরিত উঠোন, দাস-দাসীরা উপহারের পুঁটলি নিয়ে হাসিমুখে দৌড়াদৌড়ি করছে। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে আনন্দের জোয়ার, বহুদিন পর তারা বিয়ের ভোজে সবাই তৃপ্তি করে খেতে পারবে। এই উৎসবের মহাসমুদ্রে শুধু পাত্রের মাতার হৃদয়ই শূন্য…বিমর্ষ। গুলনূর যখন দাসী হয়ে এ মহলে আসে তিনি ভেবেছিলেন, গুলনূর একজন নরম, আত্মসমর্পণপ্রবণ যুবতী, যার জীবন তার সিদ্ধান্তেই বাঁক নেবে। সেই ভ্রম ভাঙে কিছুদিন আগে, যখন নিজের গহনার বাক্স গুলনূরের সামনে খুলে ধরে বলেছিলেন, ‘এই গয়নাগুলি নিয়ে, চুপচাপ চলে যা। জাওয়াদকে ভুলে যা।’
গুলনূর গহনাগুলি গ্রহণ করেছিল ঠিকই কিন্তু পরদিন যা ঘটে, তাতে স্তব্ধ হয়ে যান তিনি। জাওয়াদ, তার একমাত্র পুত্র সন্তুষ্টচিত্তে এসে জানায়, ‘ধন্যবাদ মা। এত সহজে, উপহার দিয়ে গুলনূরকে মেনে নিবেন ভাবতে পারিনি। আপনার এই উদারতা আমি সারাজীবন মনে রাখব।’
মাতৃহৃদয় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। জাওয়াদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা গুলনূরের চোখে বিজয়ের আলো জ্বলতে দেখেন তিনি। সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন বলছে, ‘আমি কোনো সাধারণ দাসী নই, বেগম সাহেবা। আমি নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করি।’
সেই দিন থেকেই ললিতার চেতনায় গুলনূরের প্রতিকৃতি সম্পূর্ণ বদলে যেতে শুরু করে। মনের অন্ধকার কুঠুরি থেকে একটি কণ্ঠস্বর প্রতিনিয়ত গুনগুন করে বলতে থাকে, চতুর, কূটবুদ্ধিসম্পন্ন, কৌশলী নারী এই গুলনূর। সে বোবা হয়েও জাওয়াদকে কোনো অলৌকিক কায়দায় বিশ্বাস করিয়েছে যে ললিতা গুলনূরকে পুত্রবধূ হিসেবে হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করে নিয়েছে। তার প্রমাণস্বরূপই বাক্স ভর্তি স্বর্ণালংকার উপহার দিয়েছে। জাওয়াদ এবং সেই গয়নার ভান্ডার, দুটোই এখন গুলনূরের মুঠোর মধ্যে! এই বিয়ের লাগাম আর তার হাতে নেই। জাওয়াদ বহুদিন পর মায়ের সাথে এতটা সন্তুষ্ট মনে কথা বলেছে কেবলমাত্র গুলনূরকে মেনে নিয়েছে ভেবে! এখন আর ললিতা এই বিবাহ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে না। জাওয়াদ আর তার নয়, এই নির্মম সত্যটি বুকের ভেতর ঠান্ডা পাথরের মতো চেপে বসে আছে। কত কিছু ছিল যা একদিন তার ছিল! স্নেহ, অধিকার, ভালোবাসা, এমনকি নির্ভরতার ছোট ছোট মুহূর্তগুলো। একে একে সব ফসকে গেছে কারও না কারও হাতে, অথবা হারিয়ে গেছে তার নিজেরই অজান্তে। সবকিছু হারিয়ে ফেলার দুঃখে ললিতা আকুল হয়ে কাঁদতে থাকেন। হৃদয়ের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে, কারো সাথে ভাগ করে নেওয়ার কেউ নেই।
ধীরে ধীরে রাত বাড়ে। ঘুমিয়ে পড়ে দাসীরা। কোনো দূর-গাঁয়ের কুকুর ডেকে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। বাড়ির সব প্রাণী-প্রাণবন্ত সত্তা, এমনকি কাকপক্ষী পর্যন্ত নিদ্রায় নিমগ্ন। শুধু ললিতার চোখে ঘুম নেই। ইদানীং তিনি একটা ঘোরের মধ্যে বাস করছেন। ঘুমালেও নিস্তার নেই। বারবার ভীতিকর সব দুঃস্বপ্নে তটস্থ হয়ে উঠছেন। স্বপ্ন ভাঙার পর বুক ধড়ফড় করে ওঠে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কোনো এক অজানা আশঙ্কা, এক অচেনা ভয় তার মনকে গিলে খাচ্ছে।
সুফিয়ান ভুঁইয়া এখনো বাড়ি ফেরেননি। এই বয়সে মানুষ কি এত গভীর রাতে বাইরে থাকে! ললিতা বারবার বারান্দায় এসে দাঁড়ান, পথের অন্ধকারে চোখ মেলে ধরে অপেক্ষা করেন পরিচিত কাঠের লাঠির ঠক্‌ঠক্‌ শব্দের জন্য। দিনদিন সুফিয়ানের প্রতি তার নির্ভরতা গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। মধ্যরাতে ভয়ে জেগে ওঠে সুফিয়ানের তুষারশুভ্র গোঁফওয়ালা শান্ত মুখখানি দেখলে আতঙ্ক অনেকটা কমে যায়। তার আশ্বস্ত করা গলায় বলা, ‘আছি আমি’, কথাটুকুই হয়ে ওঠে সমস্ত দুঃস্বপ্নের বিরুদ্ধে তার ঢালস্বরূপ। কখনো স্নেহের হাত রাখে মাথায়, কখনো আদর করে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়, তাতেই সমস্ত ভয় উধাও হয়ে যায়। আজ একা একা ঘুমাতে হবে ভেবেই অন্তরটা কুঁকড়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। জীবনের কী অদ্ভুত বিড়ম্বনা! একসময় সুফিয়ানের ছায়ার উপস্থিতিও তার কাছে অসহ্য ছিল। একই বিছানায় শোওয়ার কথা ভাবলেই গা ঘিনঘিন করত। নানা অজুহাতে সুফিয়ানকে বাড়ির বাইরে ব্যস্ত রাখার নানা ফন্দি আঁটতেন। আর এখন… জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তার প্রতিটি নিঃশ্বাসে কেবল এই মানুষটির রাতে ফিরে আসার প্রত্যাশা। মধ্যরাতের নিঃসঙ্গতায় তার কম্পিত মনটাকে দুই হাতের কোমল স্পর্শে প্রশমিত করুক। নিঃশব্দে পাশে বসুক৷ কিছু না বলেও যে কথা বলে ফেলে…সেই মানুষটা ফিরে আসুক তার কাছে।
হঠাৎ নূপুরের মিষ্টি ঝংকার ভেসে আসে। ললিতা চমকে উঠে সোজা হয়ে বসেন। কোত্থেকে যেন সেই সুরেলা রিনিঝিনি শব্দ কানে আসছে। কান পেতে শোনেন, আওয়াজটা ঠিক তার ঘরের সামনের বারান্দায়। এ বাড়িতে তো কেউ পায়ে ঘুঙুর পরে না। যদি পরেও থাকে, তার ঘরের সামনে কারো এসে দাঁড়ানোর সাহস নেই, তাও এমন নিশুতি রাতে!
তিনি গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘কে ওখানে?’
নিরুত্তর। নূপুরের সুমধুর ঝনঝনানি আরও বাড়ে। ভয় আর কৌতূহলে ললিতার কণ্ঠ শুকিয়ে আসে। বুকের ভেতরে হৃদস্পন্দন প্রচণ্ড বেগে ছুটতে থাকে। রাগ আর অস্থিরতায় তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। দুদিকে তাকিয়ে দেখেন, কেউ নেই! শুধু সুনসান রাত, আর হাওয়ার গায়ে সরসর আওয়াজ।
দেয়ালের মশালগুলোও নিভে গেছে! কে নিভিয়েছে? ললিতা প্রবল স্বরে চিৎকার করে ওঠেন, ‘কে আছো ওখানে?’
কোনো জবাব নেই। এবার ঠিক তার পেছনেই বেজে ওঠে সেই পদাঙ্গুলির অলঙ্কার। রিনিঝিনি রিনিঝিনি। ললিতা আতঙ্কিত কণ্ঠে দাসীদের ডাকেন। একবার নয়, বারংবার। কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। দাসীনিবাসে নিশ্চিন্ত ঘুমে বিভোর সবাই। ফজিলা কোথায়? নতুন নিযুক্ত ব্যক্তিগত দাসী ফজিলার তো বাইরে থাকার কথা ছিল! যতক্ষণ না সুফিয়ান ফিরে আসেন! সে কোথায় গেল? ভেতরের অস্থিরতা নিয়ে ললিতা কয়েক পা এগিয়ে যান। বারান্দার শেষ মাথায় চোখ পড়তেই নিঃশ্বাস গলায় আটকে আসে। কারো একজনের অবয়ব! নারীদেহ, ধবধবে সাদা শাড়ি পরা, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলেছে ধীর পায়ে। হাতে হারিকেন। আলো এতই ক্ষীণ যে নারীটির পায়ের কাছে আঁচলের অংশ ছাড়া আর কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। তবুও সেই চলার ভঙ্গি, সেই নিষ্কলুষ সাদা বস্ত্র, সেই খোঁড়া পায়ের হাঁটা… খুব পরিচিত ঠেকে ।
‘নয়নতারা…’ শিউরে উঠে ললিতা ফিসফিস করে বলেন। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকের ভেতরে ধুকপুকানি আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সেই খুঁড়ানো হাঁটা, সেই শুভ্র বৈধব্যের পোশাক, সেই নিভু নিভু প্রদীপের আলো! এটা কী করে সম্ভব! নয়নতারা তো মরে গেছে বহু বছর আগে! ললিতার পা যেন পাথর হয়ে যায়। মুহূর্তেই সাদা শাড়ির মেয়েটি ঘুরে দাঁড়ায়। হারিকেনের আলোয় তার অন্য হাতটা দৃশ্যমান হয়! সেই হাতে একটা ঝকঝকে চাপাতি! তীব্র আতঙ্ক ললিতার প্রতিটি রক্তকণিকায় ছড়িয়ে পড়ে। এই ভঙ্গিতেই একদিন নয়নতারাকে তাড়া করেছিল কেউ…আজ কি তার পালা?
ভয়ে ললিতার বুক চিরে বেরিয়ে আসে আর্তচিৎকার। তার বিকট আর্তনাদ শুনে সারা বাড়ি জেগে ওঠে।
সাদা শাড়ি পরিহিত নারীমূর্তিটি হাতের হারিকেন আর চাপাতি দুটোই একটা ঘরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়।
তীক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দে জাওয়াদের নিদ্রাভাঙা চোখ হঠাৎ খুলে যায়। বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে বাইরে ছুটে আসে। ডানপাশের বারান্দা দিয়ে একটি রহস্যময় ছায়ামূর্তি ভূতের মতো দ্রুত মিলিয়ে যায়। জাওয়াদ পিছু নেয় অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়া আকৃতিটির।
পায়ের মৃদু শব্দের পিছু নিয়ে সে পৌঁছে যায় পুরনো, পরিত্যক্ত ঘরগুলোর বারান্দায়। আবছা চাঁদের রুপোলি আলোয় চারপাশ ধূসর রঙে রাঙা। দেয়ালের ফাঁক গলিয়ে উঁকি মেরে খোঁজ করতে থাকে রহস্যজনক আগন্তুককে। কে ছুটে এসেছে এদিকে?
গুলনূর একটি ঘরের ভেতর ঢুকেই কাঁপা কাঁপা হাতে শাড়ির আঁচল খোলার চেষ্টা করে। শাড়ি খুলে সাদা ব্লাউজের বোতাম খুলতে যাবে, সেই মুহূর্তে কিছু একটা মেঝেতে পড়ে ঠনঠন শব্দ তোলে। তার বুকের ভেতর হৃদপিণ্ড যেন লাফিয়ে উঠে গলায় এসে আটকায়! সঙ্গে সঙ্গে কানে আসে কারো ধীর, সতর্ক পায়ের আওয়াজ। কে আসছে তার দিকে?
জাওয়াদ ঘরের ভেতর পা রাখে। তার শরীরের মাদক সুগন্ধ, নিঃশ্বাসের ছন্দময় ওঠানামা গুলনূরের চেনা। সে অন্ধকারেও বুঝতে পারে জাওয়াদ এসেছে তার খোঁজে! কীভাবে তাকে অনুসরণ করল? তবে কি তার পরিচয় ধরা পড়ে গেছে?
গুলনূর শ্বাস বন্ধ করে দেয়ালের সাথে পুরো শরীর চেপে দাঁড়িয়ে থাকে। জানালা-দরজা সব বন্ধ, ঘরে নিকষ অন্ধকার! যদি জাওয়াদের কাছে আলোর কোনো ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে হয়তো সে রক্ষা পেয়ে যাবে।
জাওয়াদ হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়ায়। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, বামদিকে কিছু একটা লুকিয়ে আছে। সে নিঃশব্দে জুতো খুলে ফেলে যাতে পায়ের শব্দ না হয়। তারপর শিকারী চিতাবাঘের মতো মৃদু পদক্ষেপে এগিয়ে যায় তার লক্ষ্যের দিকে।
গুলনূর অনুভব করে, জাওয়াদ এখন আর শুধু সন্দেহ করছে না, সে নিশ্চিত হয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে। জাওয়াদের উপস্থিতি তাকে যতটা আতঙ্কিত করার কথা, ততটা না করে বরং হৃদয়ের গভীরতম প্রকোষ্ঠে গা শিরশির করা শিহরণ জাগিয়ে তোলে। নিজের বুকের ভেতরের তোলপাড় সামলাতে না পেরে সে ঝুঁকি নিয়ে পালিয়ে যেতে উদ্যত হয়। সেই মুহূর্তে জাওয়াদ বজ্রপাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আগন্তুকের ওপর। তার পেশীবহুল বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পেছন থেকে। গুলনূরের খোলা চুলের ঢেউয়ে তার মুখ ডুবে যায়। সে কর্কশ গলায় বলে ওঠে, ‘চোর! চোর!’
পরের মুহূর্তেই তার শরীর বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো কেঁপে ওঠে। তার বাহুবন্ধনীর ভেতর যে শরীর, সেটা রেশমের মতো কোমল কোনো নারীর দেহ! সে কোনো এক রমণীর পেট জড়িয়ে ধরেছে দুই হাতের তালু দিয়ে। আকস্মিক এই উপলব্ধিতে সে ছিটকে সরে যায়, কাঁপা গলায় ফিসফিস করে, ‘কে তুমি?’
কোনো জবাব না দিয়ে বাতাসের মতো পালিয়ে যায় গুলনূর। পরনে শুধু সাদা ব্লাউজ আর পেটিকোট। বারান্দার কালো অন্ধকার গ্রাস করে নেয় তাকে। জাওয়াদ ঝড়ের বেগে পিছু পিছু ছুটে গেলেও বিশাল মহলের গোলকধাঁধার মতো পথে হারিয়ে ফেলে ছুটে যাওয়া রহস্যময়ী নারীকে।
গুলনূর দাসীদের চোখ এড়িয়ে নিজের ঘরে পৌঁছায়। দ্রুত দরজায় খিল লাগিয়ে দেয়। বুকের ভেতর হৃদয় হাপরের মতো ধুকপুক করছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই ভেসে ওঠে কিছুক্ষণ আগের আগ্নেয়গিরি মুহূর্তটি। জাওয়াদের স্পর্শ, তার বলিষ্ঠ বাহুতে আবদ্ধ হওয়া, নিঃশ্বাসের পোড়ানো উষ্ণতা সব অনুভব হচ্ছে এখনো।
হারিকেন জ্বালিয়ে নিজের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে তার মসৃণ, ফর্সা পেটে গাঢ় লাল দাগ। এতটাই আঁকড়ে ধরেছিল জাওয়াদ যে তার হাতের ছাপ পড়ে গেছে চামড়ায়। মুহূর্তকাল আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে সে।
জীবনের এই ছোট্ট পরিসরে বহুজনের ধাওয়া সহ্য করেছে গুলনূর৷ কখনো আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে, কখনো ক্রোধে দগ্ধ হতে হতে। সব ছাপিয়ে আজকের এই তাড়নায় আবিষ্কার করেছে নতুন কিছু… মিষ্টি কোনো অনুভব! পুনরায় চোখ মুদে কিছুক্ষণ আগের মুহূর্তটা কল্পনায় ফিরিয়ে আনে সে। তার অবচেতনে সেই কল্পনায় কি ভেসে ওঠে ভবিষ্যৎ? কোনো সুরেলা পাখি কি তার কানে কানে গেয়ে যায় ভবিষ্যতের গান? বলে যায়, এমন মোহনীয় ধাওয়া আরও আসবে তার জীবনে, বারবার। প্রতিটি মুহূর্তে তার হৃদয়ের অন্দরমহলে, দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় থেকে যাবে তার চিহ্ন!

নোট: আজকের পর্বে এক্সপেরিমেন্টের জন্য বর্তমান কাল ব্যবহার করেছি। ভালো লেগেছে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এখন থেকে নিয়মিত বর্তমান কালেই লিখব। পূর্বের পর্বগুলো যখন বই আকারে প্রকাশিত হবে, তখন সেগুলো সম্পাদনা করে বর্তমান কালে রূপান্তর করে নেব।

  • ইলমা বেহরোজ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top