নবোঢ়া [পর্ব ৪৯ প্রথম অংশ]

বাগানের নির্জন কোণে নীরবে বসে আছে জুলফা। হাঁটু দুটি বুকের কাছে টেনে চিবুক তাতে ঠেকিয়ে ভাবনার গহীনে হারিয়ে গেছে। ঘন সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে ছিটকে আসা রোদের রেখাগুলো শরীরে এঁকে দিচ্ছে আলো-ছায়ার আলপনা।

কিছুটা দূরে, মখমলের মতো বালির ওপর এক অপরিচিত বিড়াল আলস্যভরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জুলফার দৃষ্টি সেই পশুটির দিকেই স্থির। প্রাণীদের প্রতি তার মনে অসীম মমতা। দুপুরের খাবারের পর বাড়তি মাছের টুকরোগুলো বিড়ালটিকে নিজ হাতে খাইয়েছে।

‘আপনার কী মন খারাপ?’

হঠাৎ পিছন থেকে নাভেদের কণ্ঠ ভেসে আসতেই চমকে উঠল জুলফা। মুখজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল বিব্রতকর অস্বস্তি। ত্বরিত উঠে দাঁড়াল সে, ওড়নার আড়ালে মুখ লুকাল। একবার সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে নিল চারদিকে, কেউ দেখছে কি না। নিশ্চিন্ত হয়ে উত্তর দিল, ‘না, মন খারাপ না।’

নাভেদ কাঁধে ঠেস দিয়ে গাছের গুঁড়িতে দাঁড়িয়ে বলল, ‘মন খারাপ তো।’

‘ভুল ভাবছেন আপনি।’

‘আপনার অন্তরের ভাষা আমি পড়তে পারি, জুলফা। মুখে না বললেও আপনার মনোজগৎ আমার কাছে খোলা বইয়ের মতো।’

‘না, আপনার জানা নেই। আপনি কিছুই বুঝেন না।’

এই বলে সে পিছু হটে চলে যাওয়ার উদ্যোগ নিল। পেছন থেকে নাভেদ বলল, ‘আপনার হৃদয়ের একটি স্পন্দনও আমার অজানা নয়।’

জুলফা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তার দিকে। চোখ দুটো সরোবরের মতো নির্মল হলেও দৃষ্টিতে জমাট বাঁধা কাঠিন্য, ‘এতো খবর রাখবেন না।’

বলেই বাগান ছেড়ে মহলের দিকে মিলিয়ে গেল। নাভেদ দাঁড়িয়ে রইল পাথরের মূর্তির মতো স্তম্ভিত হয়ে। তার চিন্তার জালে জড়িয়ে পড়ল এই আকস্মিক আচরণের রহস্য। গতকালই তো তাদের মাঝে বুনন হয়েছিল নতুন সম্পর্কের সূক্ষ্ম তন্তুগুলো! কী এমন ঘটল হঠাৎ যে আজ এই বিপরীত আচরণ? একটা অনিশ্চিত আশঙ্কা ছুরির মতো বিঁধল তার বুকে। সে তৎক্ষণাৎ মহলে প্রবেশের অদম্য ইচ্ছা নিয়ে সজাগ দৃষ্টি বুলাল চারপাশে। চতুর পদক্ষেপে দাসীদের অসতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে মহলের ভিতরে ঢোকার প্রয়াস পেল। কিন্তু প্রত্যেকটি বারান্দায় নিরন্তর দাসীদের আনাগোনা, প্রহরীর মতো তাদের উপস্থিতি থাকায় জুলফা অবধি যেতে পারল না।

ভূঁইয়া বাড়ির অনাদরে উপেক্ষিত, ধূলিধূসর ঘরগুলোর মাঝে একটি ঘরের বিস্তৃত বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে আছে জুলফা। দূরের বন রাতের ঘন অন্ধকারে বিলীন। আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে অসংখ্য নক্ষত্ররাজি।

সারাদিন রোদের আগুন তাকে ক্লান্ত করেছে শারিরীকভাবে, এখন ঠাণ্ডা হাওয়ায় গা জুড়ালেও মানসিক ঘাম অবিরাম ঝরে চলেছে। একটা অজানা অস্বস্তি চিরে ফেলতে চাইছে ভেতর থেকে। চারপাশের সবকিছু খামোকাই বিরক্তিকর লাগছে। জীবনটাকে মনে হচ্ছে একটা আগুনের কুয়ো, যেখানে তার সব অনুভূতি পুড়ে যাচ্ছে ছাই হয়ে।

পরশু রাতে যখন শব্দর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, সেই মুহূর্তে তার কাছে বিশ্বজগৎের কোলাহল নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। শেষরাতে শব্দরের জ্ঞান ফিরলে কাঁপা হাতে জুলফার হাত জড়িয়ে ধরে স্মিত হেসে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলেছিল, ‘ভয় পেয়েছিলে? ভয় পেও না। তোমাকে একা করে কোথাও যাব না।’

কিন্তু সে তো যেতে চায়…নাভেদের হাত ধরে দূরে কোথাও, যেখানে শব্দরের ভালোবাসার বোঝা নেই, আছে শুধু মুক্তি। কিন্তু শব্দরের চোখের কোণে জমে থাকা জল, তার ভালোবাসা ঘেরা কণ্ঠস্বর অপরাধবোধে জুলফাকে বিধ্বস্ত করে তোলে। সিদ্ধান্তহীনতায় প্রস্তরের মতো নিশ্চল হয়ে যায় সে।

সেই রাতেই এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে। ঘোলাটে ঘুমের মধ্যে দেখে, তার হাত-পা শক্ত করে বাঁধা, সামনে শব্দর আর নাভেদ একসাথে ধীরে ধীরে পুড়ছে আগুনের লিকলিকে শিখায়। তাদের চিৎকার ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে, অথচ সে কিছুই করতে পারছে না। হঠাৎ সেই আগুন ছুটে আসে তার দিকে। শ্বাস আটকে আসে ভয়ে। তখনই জেগে ওঠে। বুকটা ধুকপুক করে ওঠে, ঠোঁট কাঁপে থরথর করে।

তারপর থেকে এক বেনামী ভয়ে আচ্ছন্ন সে। তার চেতনাকে গ্রাস করে আছে কোন অদৃশ্য অমঙ্গলের ঢেউ। যার প্রভাবে সে শব্দর আর নাভেদ দুজনকেই একইসাথে এড়িয়ে চলছে।

পাশে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে চোখ তুলতেই দেখল, নাভেদ এসেছে! ভয়ে গলা কেঁপে উঠল জুলফার, ‘আপনি! এখানে কেন এসেছেন? কীভাবে এসেছেন? কেউ দেখে ফেললে কী হবে!’

জুলফা দরজার বাইরে ভয়ার্ত চোখে তাকাল।

নাভেদ বলল, ‘আপনার মন খারাপ দেখার পর কী করে স্থির থাকি?’

‘তাই বলে মহলের ভেতর চলে আসবেন?’

কথা বলতে বলতে উদ্বিগ্ন হয়ে জুলফা পালিয়ে যেতে চাইল, নাভেদ সহসা তার হাতের কবজি ধরে ফেলল। বলল, ‘কী হয়েছে আপনার? কী নিয়ে এতো মন ভার?’

জুলফা তার হাত জোরে টেনে নিল। গলায় মিথ্যে উদাসীনতা এনে বলল, ‘মা-বাবার কথা মনে পড়ছে।’

নাভেদ এগিয়ে এলো। আস্তে আস্তে হাত বাড়িয়ে, অসীম সাহসে জুলফার চোখের কোণায় লেগে থাকা অশ্রুবিন্দু মুছে দিল। সঙ্গে সঙ্গে জুলফার শরীরে ছড়িয়ে পড়ল অবাক করা বিদ্যুতের স্পর্শ।

নাভেদ মৃদু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আপনি কাঁদবেন না, জুলফা। আপনার কান্না সহ্য হয় না আমার। আপনি কাঁদলে আপনার চোখে জল আসে কিন্তু আমার হৃদয়ে রক্তপাত ঘটে।’

জুলফা চমৎকৃত হয়ে তাকাল নাভেদের চোখে। হালকা বাতাসে নাভেদের ঢেউ খেলানো চুল নাচছে। চেয়ে আছে ব্যকুল চোখে।

জুলফার দৃষ্টি কোমল দেখে নাভেদ আরও বলল, ‘এমন করে এড়িয়ে যাবেন না। এত ব্যাকুল করবেন না।’

‘কেন এত ব্যাকুল হচ্ছেন?’

‘আপনি জানেন না?’

জুলফা নাভেদের সুন্দর মুখের দিকে পলক না ফেলে তাকিয়ে রইল। বুকের ভেতর যেন ঢাকের বাদ্য বাজছে।

নাভেদ আবেশে ডুবে বলল, ‘জানেন, বড্ড আফসোস হয়।’

‘আফসোস? ‘

‘প্রথম দিনই কেন নেশার ঘোরে আপনার হাতটা ধরে রাখিনি!’

জুলফা যেন বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলল।

‘যেদিন আপনাকে এই বাড়িতে দেখেছি, সেদিন থেকে প্রতিদিন নিজের অন্তরের সাথে সংগ্রাম করছি।’ বলতে বলতে নাভেদ চোখ নত করে কিছুটা দূরে সরে গেল। কথা বলতে আতঙ্ক কাজ করছে এমন অসহায়ত্ব ভারাক্রান্ত দৃষ্টি জুলফার মুখে রেখে বলল, ‘আপনাকে না দেখে, না ভালোবেসে থাকবার চেষ্টা করি। কিন্তু পারি না…’

শুনে জুলফার মনের ভিত কেঁপে উঠল। নাভেদ কী বলল! তার স্বপ্নের মানুষটি কী উচ্চারণ করল! তাকে ভালোবাসে! এই চোখজোড়া তাকে দেখতে আকুল…এই কণ্ঠস্বর তাকে হৃদয় দানের কথা বলল! জুলফার মনে শঙ্কা বৃদ্ধি পেল, বিশৃঙ্খল হয়ে উঠল। সে ঘুরে দাঁড়াল পালিয়ে যেতে এই অনুভূতির আবেশ থেকে। নাভেদ মিনতি করে বলল, ‘এই অধমকে ফেলে যাবেন না জুলফা।’

জুলফা অন্যদিকে মুখ রেখেই বলল, ‘এ অসম্ভব।’

‘অসম্ভব? ভালোবাসা কি কখনও অসম্ভব হয়?’

জুলফা নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করল। সে দ্বিধাদ্বন্দ্বের চরম সীমায় উপনীত। শব্দরকে মন থেকে গ্রহণ করতে পারছে না, ছেড়েও দিতে পারছে না…মায়ার বন্ধনে। নাভেদকে স্বীকার করতেও ভীত, হারাতেও অনিচ্ছুক… প্রেমের টানে। সে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘আপনি শুধু আমার একজন ভালো বন্ধু নাভেদ সাহেব।’

নাভেদ মৃদু হাসল। এগিয়ে এসে জুলফার নিকটে দাঁড়িয়ে বলল, ‘নিজেকে প্রবোধ দিবেন না। আপনার চোখের ভেতরে যে নদী দেখি আমি, সেখানে তো আমার ছবিই দেখি।’

‘ভুল দেখেন।’

‘আমি ভুল দেখি না। আপনার দৃষ্টি আমার ভালোবাসাকে কবেই স্বীকৃতি দিয়েছে৷ আমি আপনার সবটুকু মনের খবর জানি।’

জুলফার ভেতরে কিছু ভেঙে যাচ্ছে। হয়তো সেটা সদ্য জন্মানো অজানা ভয়! এই ভীতিই ছিল তার অভিশপ্ত জীবনযাপনে প্রবেশের শেষ প্রতিবন্ধক। কিন্তু এখন সে সেই বাধা অতিক্রম করতে উদ্যত নাভেদের কথার মোহনীয় শক্তিতে।

জুলফা ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমি…আমি বিবাহিত।’

সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হলো।

নাভেদ হাত বাড়িয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ‘বিবাহিত তাতে কী? ভালোবাসা কী সীমা পরিসীমা ভাবে? তাছাড়া আপনি তো ভালোবেসে বিয়ে করেননি। আপনাকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আপনার অধিকার আছে ভালো থাকার, সুখে থাকার। শব্দর ভূঁইয়া কি আপনার হাসির কারণ? না, হাসির কারণ নয়। তাই এই বিয়ের তো কোনো মূল্যই নেই।’

জুলফা দিশেহারা হয়ে বারান্দার রেলিং আঁকড়ে ধরে বলল, ‘আমি…আমি খুব ভয় পাচ্ছি।’

‘ভয়? কিসের ভয়?’

‘জানি না। কিন্তু ভয় পাচ্ছি।’

‘আমিও ভয় পাই, জুলফা। আপনি

সারাজীবন একটা জোরপূর্বক সম্পর্কের বেড়াজালে আটকে থেকে, নিজের অস্তিত্ব ভুলে যাবেন সেই ভয় পাই।’

‘আমার জীবন তো কারো হাতে তুলে দেয়া হয়ে গেছে। আমি মুক্ত নই। আমি তো কারো সম্পত্তি…’

‘মানুষ কোনো সম্পত্তি নয়, জুলফা।’

‘সমাজ এ সম্পর্ককে পাপ বলবে!’

‘ভালোবাসা কখনো পাপ হয় না। পাপ তো তখন হয়, যখন আপনি এমন কারো পাশে সারাজীবন কাটান, যাকে আপনি ভালোই বাসেন না। ভালোবাসা পাপ নয়, ভালোবাসাকে মেরে ফেলাই পাপ।’

জুলফা জবাব দেওয়ার আগেই নাভেদ ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। জুলফার দুই গাল আলতো হাতে ধরে কোমল স্বরে বলল, ‘আপনি শব্দর ভূঁইয়াকে ভালোবাসেন না। কখনো বাসেননি, শুধু মানিয়ে নিয়েছেন। এই মানিয়ে নেয়াটাই একদিন আপনার মনটাকে মেরে ফেলবে। আপনার হাসিটা নিভে যাবে, আপনার চোখের আলো নিঃশেষ হয়ে যাবে।’

জুলফার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। বহুদিনের অসহায়ত্ব যেন সেই অশ্রুর সাথে ঝরে পড়তে লাগল। সে চোখ নত করে অবরুদ্ধ কণ্ঠে কাঁদতে লাগল, নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে।

নাভেদ ভীষণ যত্নে জুলফার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল, ‘আমি আপনার চোখে সূর্য দেখি, চাঁদের হাসি দেখি। আমি চাই না, সেই আলো নিভে যাক। আমি দেখেছি কীভাবে আপনার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যখন আপনি আমার দিকে তাকান…সেই আলো নিভবে, এটা আমি সহ্য করতে পারব না।’

জুলফা পিছিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেল। পা আর চলছে না, হৃদয় আর ভাবছে না সমাজ কিংবা শব্দরের কথা। নাভেদ তার মুখের কাছে মুখ এনে বলল, ‘ভুল সময়ে আমরা একে-অপরকে ভালোবেসেছি, এটা সত্যি। কিন্তু ওই ভুল সময়টুকু কি আমাদের ভালোবাসার দোষ? বিয়ে তো সমাজের চুক্তি, চাইলেই ভেঙে অন্য সমাজে ঢোকা যাবে৷ কিন্তু অজান্তেই দুটি হৃদয়ের যে চুক্তি হয়েছে, যে বন্ধন তৈরি হয়েছে অনুভূতির গভীরে, সেটা কীভাবে ভাঙবেন? পৃথিবীর কোন শক্তি ভালোবাসার বন্ধন ছিঁড়তে পারে?’

জুলফা হাপুস নয়নে কাঁদছে। তার সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। নাভেদের প্রতিটি কথা তার অন্তরের গভীরে লুকিয়ে থাকা সত্যকে উন্মোচন করে দিচ্ছে একে একে। শব্দরের প্রতি জন্মানো মায়া হেরে যাচ্ছে, যেখানে কেবল দায়িত্ববোধ, সামাজিক বাঁধন ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

‘জোর করে হয়তো সংসার করবেন, কিন্তু সেখানে থাকবে না গান, থাকবে না কবিতা, থাকবে না সেই জাদুকরী স্পর্শ যে স্পর্শ প্রেমিক হৃদয়ের ভেতর কাঁপন তোলে।’

বলেই জুলফার গালে আলতো করে স্পর্শ করল নাভেদ। তার আঙুলের স্পর্শে জুলফার সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। নাভেদ ফিসফিস করে বলল, ‘কিন্তু আমি স্পর্শ করলে আপনি গান, কবিতা সবই অনুভব করেন। আমার স্পর্শ আপনার ভেতরে কাঁপন তোলে।’

জুলফা জোরে নিশ্বাস ফেলল। বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড এত জোরে কাঁপছে যে, মনে হচ্ছে এক্ষুণি বুক চিরে বেরিয়ে আসবে। নাভেদ সব সত্য বলছে। তার ভেতরটা নিংড়ে বেরোচ্ছে নাভেদের প্রতিটি কথায়। শব্দরের সাথে একটি দিনও সে এমন অনুভূতি পায়নি।

‘আপনি যদি আমাকে ত্যাগ করেন, এই ভালোবাসাকে অস্বীকার করেন তাহলে শুধু নিজের জীবন নষ্ট করবেন না, আমারটাও শেষ করে দেবেন।’ নাভেদের কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠেছে, চোখে জল টলমল করছে, ‘আপনি যদি আমার না হোন, তাহলে আমার কোনো সার্থকতা থাকবে না, কোনো দিশা থাকবে না। আমি ডুবে গেছি, ফেঁসে গেছি আপনার প্রেমে। আর সম্ভব হচ্ছে না ভালোবাসা চেপে রাখা। আজ শুধু সত্যটা জানতে চাই আপনার মুখে। স্বীকার করুন, আপনার হৃদয়ে আমার জন্য জায়গা আছে? অথবা বিদায় দিন। চিরতরে বিদায় দিন আমাকে।’

কথাগুলো জুলফার হৃদয়ে ছুরি হয়ে বিঁধল। বিদায়? না, সে পারবে না। পারবে না নাভেদকে হারাতে। তার সমস্ত সত্তা কাঁপতে লাগল। ঠোঁট কাঁপল অনিয়ন্ত্রিতভাবে।

এই মানুষটা তাকে হাসায়, তার ছোট ছোট আহ্লাদ সহ্য করে। ছোট ছোট স্বপ্ন পূরণ করে, তার মনের কথা বোঝে। সেই মানুষটাকে সে বিদায় দিতে পারবে না৷ কিছুতেই না৷ সে বরং মরেই যাবে, তবু এই মানুষটাকে হারাবে না।

নাভেদ বলল, ‘আপনি চাইলে আমি সারাজীবন অপেক্ষা করব, কোনো দাবি করব না। শুধু সত্যিটা স্বীকার করুন, একবার শুনতে চাই, আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন?’ আবেগে জর্জরিত গলায় ফিসফিসিয়ে আবারও প্রশ্ন করল, ‘আমাকে ভালোবাসেন না জুলফা?’

জুলফার হৃদয়জুড়ে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা সংশয়, ভয় আর অপরাধবোধ একসঙ্গে খসে পড়ল। সে আর মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারল না। সমস্ত বাঁধ ভেঙে পড়ল। ধীরে ধীরে তাকাল নাভেদের দিকে। চোখদুটো লাল, কণ্ঠ কাঁপছে, বুকের ভেতর হাজারো প্রজাপতি ডানা ঝাপটাচ্ছে। ধরা গলায় বলল, ‘সত্যিটা যতই লুকোই, বুকের ভেতর আপনি ছাড়া কিছু নেই নাভেদ। আপনিই আমার প্রথম, আপনিই আমার শেষ।’

জুলফার কথা শুনে নাভেদের চোখ থেকে জল ঝরে পড়ল। অশ্রুসজল চোখ নিয়ে সে হাসল, এতদিনের প্রতীক্ষা আজ সার্থক। জুলফাকে টেনে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল সে। এমন করে যেন আর কখনো ছাড়বে না। কপালে এঁকে দিল কোমল চুমু। বহুদিনের সংযম ভেঙে পড়ায় জুলফা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নাভেদকে৷

  • ইলমা বেহরোজ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top