প্রাণদায়িনী [শেষ পর্ব]

শাড়ির আচঁলটা ডানহাতে কায়দা করে পেঁচাতে ব্যস্ত তায়েফ, চোখের দৃষ্টি শান লাগালো ছুড়ির মতো ধারালো হয়ে আছে। আচঁলে টান খেতেই এক ঝটকায় সৌষ্ঠব্য বুকটার উপর হুমড়ি খেয়ে পরলো, টের পেলো তার বাহুদুটো কেউ পাঁচ আঙ্গুলে কঠিনভাবে ধরেছে। এশা লোকটার বুকের উপর দুহাত রেখে জোরে একটা ধাক্কা মারলো, কোনো লাভ হলো না। উলটো হাতদুটো খামচে ধরে ব্যথা দিচ্ছে এখন। এশা অস্ফুট স্বরে চাপা আর্তনাদে গোঙিয়ে উঠলো, তবুও তায়েফ ছাড়লো না। এশার দু’বাহু ধরে আকস্মিকভাবে এমন ধাক্কা মারলো, এশা এবার সবচেয়ে ভয়ানক ব্যথাটা পেয়ে রুম কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠলো। পিঠে সূঁচালো কিছু খুব গভীরভাবে বিঁধে যাচ্ছে, তায়েফ সেই জায়গায় আরো জোরে ধাক্কা দিয়ে ঝাঁঝিলো সুরেই বললো,

এখন যদি তোমার বারোটা বাজাই তাহলে কেমন —-
হঠাৎ চিন্তার দরজায় কড়া বাজিয়ে রুমে ঢুকলো আফিফ। রুমের লাইট নেভানো বলে ছোট বোনকে জাগ্রত দেখেনি। এশা যেনো অন্ধকারের সুযোগ পেয়ে চোখ খোলা রেখেই দরজার কাছে দাঁড়ানো আফিফকে দেখতে থাকলো। আফিফ ভেতরে ঢুকলো না, দরজাটা ফের চাপিয়ে চলে গেলো। ব্যাপারটা দেখে আশ্চর্য হলো এশা! আজ যদিও এশার ঘুমাতে দেরি হচ্ছে, মানসিক ধকলে পরেছে বিধায় ঘুম নেই, কিন্তু আফিফ এখানে কি দেখে গেলো? এশার মনটা কৌতুহলের রেশে খচখচ করতে লাগলো। অন্যসময় এ টাইমে বেঘোরে ঘুমায় এশা, কিন্তু আজ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জেরে একটু উলোটপালোট হয়ে গেছে। এশা ডানকাত ফিরে চুপচাপ শুয়ে পরলো, চোখদুটো আবার বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ব্যর্থ হিসেবে যখন ঘুম এলোই না, তখনই বালিশের নিচ থেকে ভুম ভুম শব্দে ফোন কাঁপতে লাগলো। এশা চোখ বন্ধ করেই বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিলো, কম্পমান ফোনটা বালিশের তলা থেকে বের করবে তখনই সেটা কেটে গেলো। এশা আর চোখ খুলে দেখলো না, ফোনটা ছেড়ে দিয়ে সদ্য নিদ্রায় তলাতে লাগলো। ঘুমের রেশটা কেবলই গাঢ়র দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, এর মধ্যে পরপর দুটো অদ্ভুত আওয়াজ পেলো এশা। আকস্মিক এই আওয়াজগুশো কখনোই এ বাড়িতে শোনেনি। এই কন্ঠ তার ভাবী তায়েবারও না। এশা চট করে চোখ খুলে শোয়া থেকে উঠে বসলো, বিছানা থেকে দ্রুতগতিতে নামলেও খুব আস্তে করে দরজা খুললো। এবার স্পষ্টভাবে শব্দটা শুনতে পাচ্ছে এশা, এটা কোনো মেয়ের কন্ঠ, একটা মেয়েলি সুর চিনতে সে কখনো ভুল করবে না। কিন্তু অপরিচিত এই কন্ঠ কোত্থেকে উদয় হলো? এসব নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হলে হঠাৎ কেনো জানি একটু আগে আফিফের আচরণটার উপর সন্দেহ জাগলো। তার ভাই কি…
‘ অসম্ভব, অসম্ভব! ‘ এশা তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধালো। অবচেতন মন যে কতো ভয়ানক চিন্তা ভাবনা করছে সেটা মুখে বলতেও বিবেকে বাঁধছে ওর। এশা তবুও নিজের মনকে আশ্বস্ত করার জন্য শব্দ উৎসের খোঁজ না লাগিয়ে ভাই-ভাবীর রুমের দিকে গেলো। পা টিপেটিপে আধ-ভেড়ানো দরজার সামনে যেতেই বুকভর্তি দম নিলো এশা, এরপর দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে আস্তে করে সেটা ধাক্কা দিয়ে দিলো। দরজাটা ধীরে-ধীরে রুমের ভেতরে ঢুকে যেতেই এশা সর্তকভাবে একপা এগুলো, নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে আবছা রুমের দিকে দৃষ্টি বুলালো। বিছানার দিকে চোখ পরতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো এশার, সমস্ত শরীর যেনো বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে এলো। তায়েবা, ফাইজা দুজনেই আছে কিন্তু আসল ব্যক্তিটাই নেই। এশা আর বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে পা চালিয়ে সেই শব্দ উৎসের খোঁজ লাগালো। অনেক চেষ্টা করার পর আবিষ্কার করলো, শব্দটা রান্নাঘরের পাশের ঘর থেকে আসছে। সেই ঘরটা কেবল কাজের মহিলাদের থাকার জন্য বরাদ্দ। দু’সপ্তাহ যাবৎ সাবু খালা নেই, তাই ওই রুমটা বন্ধ। তিনি গ্রামে গিয়েছেন বিধায় ওই রুমটায় তালা দেওয়া হয়েছিলো, অথচ সেই রুমটায় তালা নেই। উলটো দরজার নিচ দিয়ে সরু ফাঁক অংশ গলে এনার্জী লাইটের বাতি দেখা যাচ্ছে। এশা নিঃশব্দে সেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলো, দরজাটা ভেতর থেকে আটকানো কিনা জানা নেই ওর। তাই দরজার উপর হাত রেখে আলতো একটা ধাক্কা দিয়ে পরোখ করে নিলো। ধাক্কা দিতেই দরজাটা ভেতরের দিকে যাচ্ছে, তার মানে দরজাটা খোলাই আছে। কিন্তু খোলা রেখেছে কি জন্যে? এশা শুষ্ক ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বড় একটা ঢোক গিলদো। নিজেকে একটু শান্ত-স্বাভাবিক করে আচমকা এক ধাক্কা মেরে বসলো, সরাৎ করে কাঠের দরজাটা খুলে যেতেই চোখের সামনে নোংরা দৃশ্য ভেসে উঠলো! তার ভাই যে এখন বিবাহিত, যেকিনা এক বাচ্চার বাবা, একজন পেশাদার ডাক্তার, যার নাম-ডাক বেশ ভালোই শোনা যায়, সেই ভাই অজ্ঞাত একটা মহিলা নিয়ে নিজ বাঢ়িতে নোংরামি করছে! অজ্ঞাত মহিলাটা তাড়াতাড়ি নিজের পোশাকহীন শরীরে কম্বল টেনে নিচ্ছে, আফিফ নিজের বোনকে এভাবে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দেখতে পেয়ে আমতা-আমতা করছে। এশা বাকরুদ্ধ অবস্থায় কোনো স্বাভাবিক আচরণ করতে পারছিলো না, বিষ্ময়ে বড় বড় হওয়া চোখদুটো অশ্রুধারায় টলটল করছিলো তার। আফিফ দ্রুত একটু ভদ্রস্থ হওয়ার চেষ্টা করতেই এশা একদৌড়ে তায়েবার কাছৈ ছুটে গেলো। ঘুমন্ত তায়েবাকে ডেকে তুলেও লাভ হচ্ছিলো না, এদিকে যে ঘুমের ঔষুধ খাইয়ে তায়েবাকে থিতিয়ে রেখেছে সেটা পরে বুঝতে পারে এশা। নিরুপায় এশা ভাবীকে ওভাবেই ছেড়ে ফের ওই রুমের দিকে ছুটে পালায়, অচেনা মেয়েটা ততক্ষণ সাবলীল পোশাকে গা ঢাকা দিয়ে ফেলেছে। মেয়েটা যেই রুম থেকে বেরুতে নেবে তখনই এশার বাধা খেয়ে সটান করে দাঁড়িয়ে যায়, এশাও রাগে-ক্ষোভে-তিক্ততায় কষিয়ে মার মারে মেয়েটার গালে। মেয়েটা গাল বুলাতে-বুলাতে কটমট দৃষ্টিতে এশার দিকে তাকালো, এরপর অকথ্য ভাষায় বলে উঠলো,

আমার গালে না মা’ইরা তোর ভাইয়ের গালে যাইয়া লাগা। আমারে কোন্ সাহসে মা’রতে যাস ? তোর ভাই রাতবিরাতে ঘরে বউ-বাইচ্চা থুইয়া মাতারি খুইজা বেড়াইবো, আর হাতে-নাতে ধরা পরছে দেইখা আমারে মা’রোস!
পরপর দুটো অ’শ্লীল ভাষায় গা’লি দিয়ে উক্ত মহিলাটা বেরিয়ে গেলো। রাগে শক্ত হয়ে থাকা এশা ভাইয়ের দিকে অশ্রুচোখে তাকালো, রাগে হাতের মুঠোগুলো মুষ্ঠি হয়ে গেছে। আফিফ নিজেকে গা ঢাকা দেওয়ার জন্য মিথ্যা পায়তারা সাজাতে থাকে,দ্যাখ এশা, তুই যা দেখলি এটা একদম ভুল। ওই মহিলা উলটো আমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে। বলেছে তার কথা যদি না মানি তাহলে আমার মেডিকেল প্রস্টিজ খুইয়ে দিবে। আমার কোনো দোষ নেই বোন, একটাবার আমার কথা শোন। এশা তুই তোর ভাবীকে —
আফিফ কথাগুলো শেষ করার পূর্বেই গলা চড়ালো এশা। ক্রোধে গা শুদ্ধো কাঁপছে ওর। ভাইয়ের দিকে জীবনে এই প্রথম তেজালো সুরে বললো,

তুমি যে একটা জঘন্য লোক, জঘন্য মেন্টালিটি নিয়ে থাকো সেটা আজ চাক্ষুষ দেখলাম ভাইয়া। এসব দেখার পরও তুমি বানোয়াট কথা সাজাচ্ছো? তুমি কি আমাকে মূর্খ পেয়েছো? আমি কি তোমার কূকীর্তি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস করবো না? তুমি খুবই জঘন্য! খুব জঘন্য! খুব বেশিই জঘন্য ভাইয়া! ওই তায়েফ তোমার ব্যাপার নিয়ে যখন বলেছিলো, আমিই এক গাধা তার কথা বিশ্বাস করিনি। উলটো তাকেই যা-তা ভাষায় বকাঝকা করে এসেছি, চড় মেরেছি। তোমাকে নিয়ে এসব ভাবতেও আমার তখন কষ্ট হচ্ছিলো ভাইয়া, কিন্তু আজ এসব সত্যি দেখে তার চেয়ে বহু মাত্রায় কষ্ট হচ্ছে। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ!
.
শহরের বুকে যেনো সদ্য শীতের ছোঁয়া লেগেছে। পরিবেশটা কুয়াশায় ঢেকে না গেলেও ঠান্ডা বাতাসে পশম যেনো কাটা দিয়ে উঠে। পাখিরা ভোর সকালে হালকা মতোন কিচিরমিচির করে, কিন্তু সকাল হলেও শব্দ বন্ধ। সূর্য্যিমামাও যেনো শীতের আগমন দেখে দেরিতে তেজ ছড়ান, পৃথিবীর বুকে স্বল্প তাপমাত্রায় উষ্ণতা দেন। গ্রামের মানুষগুলো কনকনে শীতের মধ্যে ঘুম ত্যাগ করলেও শহরের একদল মানুষ দশটা অবধি ঘুমায়। যারা মূলত ব্যবসার হালটা নিজের মতো করে টানে তাদের জন্য শীতের সকালটা আরামদায়ক। যখন খুশী তখন তারা রেডি হয়ে নেয়, নাস্তা সারে, এরপর অফিসের পরিবেশটায় চোখ ঘুরাতে গাড়ি নিয়ে ছুটে। এমনই এক শীতের সকালে ন’টা অবধি ঘুমাচ্ছে তায়েফ। বিশাল বড় বিছানায় একাই দখল করে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমটা একটু পাতলা হলেও উঠতে ইচ্ছে করছেনা। হঠাৎ নিবরতার ঠান্ডা পরিবেশে মেজাজ চড়ানো কন্ঠ আসলো, দরজাটা নক করেই ভেতরে ঢুকে গলা উঁচিয়ে আজ্ঞা চাইলো,

আসতে পারি বস?
তায়েফের মুডটা সেকেন্ডের ভেতর বিগড়ে গেলো। জুতাপেটা করে ব্যাটাকে কঠিন কিছু বলতে ইচ্ছে করছে, সকালটা যেনো খারাপ দিয়ে শুরু না হোক, তাই তায়েফ রাগ দমন করে বললো,

কি চাই?
ঠোঁটে এক প্রস্থ হাসি ঝুলিয়ে বসের উদ্দেশ্যে বললো,

বস, ওই শয়তানকে মুরদা বানিয়ে দিয়েছি। কেউ ওর খবর পাবেনা। ব্যাংকেও টাকা পাঠানো হয়ে গেছে। এরপর আর কি হুকুম আছে বস?
তায়েফ ঘুম ঘুম চোখে নিদ্রাজড়ানো কন্ঠে বললো,

বউ দরকার। একটা বউ নিয়ে আসো। আরাম করে শীতটা একটু কাটাই। আহা, শীত! বউ ছাড়া শীত, আর বালিশ ছাড়া বিছানা দুটোই কষ্টদায়ক।
তায়েফের করা শুনে আহাম্মক হয়ে গেলো সাঙ্গুটা। কি উত্তর দিবে সেটা বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলো, তার বস মানুষটা কি বিয়েটিয়ে করতে চাচ্ছে নাকি? সাথে,সাথে সাঙ্গুটা মনে-মনে বলে উঠলো, ‘ আরে খোদা, কাম সারছে! ‘
ঘড়িতে বাজে সন্ধ্যা ছয়টা। ছয়টা পনেরোর দিকে নৌযানটা ছাড়ার কথা। তিনতলা বিশিষ্ট বিলাসবহুল নৌযানে উঠেছে এশা। একটা বড় কেবিন বুক করেছে এশা। বিশাল বড় কেবিনটায় ডাবল একটা বিছানা। নরম বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরের অবস্থা দেখছে সে। নীল আকাশটা ভারী সুন্দর লাগছে। তিনতলার এই কেবিনটা মূলত একারনেই বেশি টাকায় নেওয়া, কারণ এখান থেকে আকাশ দেখতে মারাত্মক লাগে! এশা দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে জানালার দিকে মুখ করে আছে। ভেতরটা মনটা আজ ভালো নেই, ভাবী তাকে পড়াশোনা শেষ করার জন্য আবার গন্তব্যে পাঠিয়ে দিচ্ছে। শহরের বুকে ভাবী এবং ফাইজাকে একা ছাড়তে ইচ্ছে করছেনা, মনটা যেনো ভীষণভাবে নারাজ। কোলের উপর ফোনটাও এখন আর বাজেনা, সেই রাতের মতো একটু ভুম ভুম করে উঠেনা। ঝড়ের মতো লন্ডভন্ড করার জন্য এসেছিলো ওই ব্যক্তি, ঝড়ের মতোই তছনছ করে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে সে। এশার পিঠে যে ছোট্ট একটা ক্ষত হয়েছে, সেটা ওই ব্যক্তির দেওয়া আঘাত। সেদিন এশার পিঠে ছোটখাট সরু ছিটকিনির মাথাটা বিদ্ধ হয়েছিলো, তারই বদৌলতে এখনো পিঠের ডানদিকটায় ব্যথা করে। আচ্ছা, ওই ব্যক্তিকে নিয়ে কেনো এশা ভাবছে? এশার সাথে তো তার যোগাযোগ নেই, তেমন সৌজন্যমূলক কথা হয়নি, কখনো দেখা হবে কিনা তাতেও সন্দেহ রয়েছে। হঠাৎ এশাকে চেতন করে রুমের দরজায় কেউ ঠকঠক করে উঠলো। এশা ভাবলো, হয়তো ম্যানেজার গোছের কেউ পরিদর্শনের কাজ সেরে নিচ্ছে। কেবিনে সব যাত্রী উঠেছে কিনা সেটাই হয়তো দেখতে এসেছে। এশা শান্তভঙ্গিতে বিছানা ছেড়ে নামলো, ক্রমাগত অস্থির ভঙ্গিতে ঠকঠক করা দরজার দিকে বিরক্তি নিয়ে এগুতে লাগলো। এশা টের পেলো নৌযান ছাড়ার সাইরেন বাজছে, বাজতে-বাজতেই দরজাটা খুলে দাঁড়ালো এশা। অপ্রত্যাশিত কিছু দেখতে পেয়ে আশ্চর্যে যেই চেঁচিয়ে উঠবে, তৎক্ষণাৎ মুখে হাত চাপা দিয়ে দরজাটা পায়ে ঠেলে বন্ধ করে দিলো। এশাকে ওই অবস্থায় পিছনে ঠেলতে-ঠেলতে একেবারে বিছানায় গিয়ে বসালো। এশা যেনো আঁটকে রাখা নিশ্বাস ছাড়তে পেরে হাঁফ বাচঁলো, চোখ বন্ধ করে জোরে-জোরে দম নিতে থাকলে হঠাৎ সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে শিউরে উঠলো এশা! ব্যস্ত ভঙ্গিতে চোখ খুলে তাকাতেই তায়েফের অবস্থা দেখতে পেলো। ফ্লোরে বসে এশার কোলে রেখে দিয়েছে তায়েফ। চোখদুটো পুরোপুরি বন্ধ করা অবস্থায় এশার হাতদুটো কাছে টেনে আনলো। একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের গালে রাখলো, অন্যহাতটা টেনে নিয়ে মাথার চুলের উপর ছেড়ে দিলো। এশা নির্বাক হয়ে কপাল কুঁচকে দেখছে, তায়েফের মতিগতি ধরার চিন্তায় আছে সে। তায়েফ সন্তপর্ণে নিজের হাতদুটো বাড়িয়ে এশার কোমরটা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো, কোল থেকে মুখটা তুলে এশার হতবাক দৃষ্টির দিকে তাকালো। কন্ঠস্বর যথাসম্ভব কোমল করে বললো,

আমাকে কোনোভাবে কি বিশ্বাস করা যায় না?
এশা কোনোরূপ বাক্য উচ্চারণ করলো না, কঠিনভাবে চুপ রইলো। এমনভাবে সংযত রইলো যেনো তায়েফের উপস্থিতি তাকে বিচলিত করছেনা, অস্থির করছেনা, আনচান করছেনা, কোনোরূপ উৎকন্ঠার উদ্রেক ঘটাচ্ছে না। তায়েফ একদৃষ্টিতে এশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো, পরক্ষণে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো,

আমিও যদি তোমার ভাইয়ের মতো জঘন্য কাজটা করি তাহলে কি বিশ্বাস করবে?
থরথর করে কেঁপে এশার ওষ্ঠযুগল। এ যেনো ঝড়ের আগে নিরবতার সংকেত। তায়েফ পরবর্তী কথা বলতে-না-বলতেই এশা হুঁ হুঁ করে কেঁ উঠলো। চলমান নৌযানটা আকাশের পেঁজো পেঁজো তুলোর মতো মেঘগুলো ছাড়িয়ে যাচ্ছে, শো-শো করে জানালা থেকে নদীপথের হাওয়া আসছে। শীতল হচ্ছে রুমের পরিবেশ। তায়েফ কোল থেকে সরে গেলো, এশার হাতদুটো গাল ও মাথা থেকে সরিয়ে নিলো। এশার আরো সন্নিকটে যেয়ে ফ্লোরে বসেই গলা জড়িয়ে ধরলো ওর। এশা অশ্রু ভেজা গলায় মুখ লুকালো তায়েফ, পিঠের দিকে ডানহাত বাড়িয়ে সেই ব্যথার জায়গাটা স্পর্শ করলো। গলার স্বরটা ঠান্ডা করে বলতে লাগলো,

ব্যথাটা না দিলে তুমি যে কাগজে সই করতে না এশা। তোমার ভাইকে জব্দ করার জন্যই তোমাকে কষ্ট দিতে এনেছিলাম। কিন্তু তোমার আচঁড় দিতে গিয়ে আমার ব্যথা অনুভব করেছি এশা। মানুষ আমার চরিত্র নিয়ে যে পরিমাণে গুজব ছড়িয়েছে, আমার জমজ বোনই আমাকে আর বিশ্বাস করেনা। আমি ক্লাবে যাই, ফূর্তি করি, কিন্তু কোনোদিন কোনো মেয়েকে তোমার ভাইয়ের মতো দেখিনি। এই শীতগুলো খুব যন্ত্রণাদায়ক এশা, আমাকে দ্রুত বিয়েটা করে উদ্ধার করো। এখনো বালিশ আঁকড়ে ঘুমাতে হয়, এর চেয়ে জঘন্য ব্যাপার হয় বলো? দ্রুত আমাকে বিয়ে করো, আমার বুকটার মধ্যে চলে আসো। তোমাকে ভয়ংকর ভাবে ভালোবেসে ফেলেছি এশা, এদেশ থেকে যদি চলে যাই, তোমাকে নিয়েই বিদায় হবো। তুমি রাজি আছোতো?
এশা এদফাতেও চুপ। হ্যাঁ, না কিছুই না বললো না। তায়েফ অনুভব করলো, এমন নিঃশব্দ পরিবেশে এশার রোদনধ্বনি আর শোনা যাচ্ছেনা। তার মাথা একটু-একটু করে ছুঁয়ে যাচ্ছে কোমল ওষ্ঠজোড়ার পরশ।
‘ প্রাণদায়িনী তুমি, প্রাণনাশিনী আমার।
তোমার জন্য ক্ষিপ্ত ছিলাম, তোমাতেই আসক্ত আজ। ‘
সমাপ্ত .

  • ফাবিয়াহ্ মমো .

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top