বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-০৩]

গ্যারেজে জিপগাড়িটা রেখে এসে উৎস আর উচ্ছ সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেই উষা এসে পথ আটকান ছেলেদের।উচ্ছ দাঁড়িয়ে গেলেও উৎস অন্যদিকে ঘুরে চলে যেতে নিলেই উষা রেগেমেগে বলেন,“ বেয়াদবি করো না উৎস।”

সাথেসাথেই উত্তর আসে,“ আমি বেয়াদবি করছি না। আপনি সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন তাই অন্যপথ বেছে নিয়েছি।”

উৎসের কথাটা স্বাভাবিক হলেও উষা কিছুটা বিচলিত হন।কথাটা তার কাছে মোটেও স্বাভাবিক মনে হয়নি।এখানে আরেকটা কথা বলা মানেই পরিস্থিতি অন্যদিকে ঘুরে যাওয়া বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরে উচ্ছকে নিজের সাথে আসতে বলে চলে যান।উৎসও চলে যায়।উচ্ছ উৎসের পিছু পিছু যায়। তার অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও পায়নি।ব্রিজে ড. আশিনের সাথে উৎস কি করছিলো?এটা নিয়ে যতক্ষণ না পর্যন্ত মাথাটা ভালোভাবে না ঘামাবে ততক্ষণ পর্যন্ত উচ্ছে শান্তি হবে না এটাই তার ভাবনা। উৎস নিজের ঘরে এসে শার্ট-টা একটান মেরে খুলে বিছানায় ছুড়ে মারে।উচ্ছ তার রুমে এসে বলে ওঠে,“ জিনিসপত্রগুলো জায়গামতো রাখা ভালো।”

উৎস স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই জবাব দেয়, “এসব তোর দ্বারা হলেও আমার দ্বারা অসম্ভব।”

উচ্ছ আড়চোখে উৎসের কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করে প্রশ্ন করে,“ ড. আশিনের সাথে কি করছিলি তুই ওখানে?আর কিসের দ্বিগুণ হওয়ার কথা বললো?”

ভ্রু কুচকে ফিরে তাকায় উৎস।প্রশ্নটা মোটেও পছন্দ হয় নি তার।অন্য কেউ শুনলে মেয়েটার বদনাম রটাতে পারে।বখাটে হলেও এমন বিষয়ে উৎস নেই।মেয়েঘটিত ব্যাপারে সে খুব একটা মাথা না ঘামালেও আজ খুবই মজা পেয়েছে।কোমল হাতের চড়টাও কিন্তু এখনও ভুলে যায় নি।আশিনের চড়ের কথা মাথায় আসতেই গালে হাত দেয় উৎস।কয়েক সেকেন্ডের জন্য হঠাৎ রাগ উঠে।মেয়েটাকে এবার খুব ভোগান্তিতে পড়তে হবে এমনটার জন্য এটা ভেবে নেয় উৎস।এদিকে উচ্ছ লাগাতার প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।এমন ফাউল প্রশ্ন কেউ কি করে এ বিষয় জানা নেই উৎসের।জবাব না দিয়ে শাওয়ার নেওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢোকার আগে উচ্ছ আবারও গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন করে বসে,“ বলে যা না আগে।”

“ আমাকে চায়ের নিমন্ত্রণ জানাতে এসেছিলো।আমি না করায় পরেরবার দেখা হলে চায়ের পরিমাণ দ্বিগুণ হবে বলেছে।”

কথাটুকু বলেই ওয়াশরুমের দরজা ধরাম করে বন্ধ করে।উচ্ছ কানে হাত দেয়।উৎস যে তাকে সত্যিটা বলছে না এটা একদম পরিষ্কার।উচ্ছ চেচিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই কেউ ঘরে প্রবেশ করে। দরজার দিকে তাকাতেই দেখে তার ছোট কাকার মেয়ে তন্নি।তন্নিকে এই সময়ে উৎসের রুমে আসতে দেখে উচ্ছের ঈষৎ ভ্রু কুচকে যায়।সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,“ তুমি এখানে কি করছো?”

তন্নি উচ্ছকে এখানে দেখে মাথা নিচু করে বলে,“ভাইয়া বড় বাবা উৎসকে না মানে উৎস ভাইয়াকে ডাকছে।”

“ ঠিক আছে তুমি যাও।আসছি।”

“ না না আপনাকে নয় উৎ…”

মেজাজ চটে যাচ্ছে উচ্ছের।তবুও মুখে তার বিন্দুমাত্র প্রকাশ না করে বলে,“ আমি বলে দেবো।তুমি যাও।”

তন্নি ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকে ওদিকে তাকায়।উৎসকে একপলক দেখার আশায়।আজ সারাদিন দেখতে পায় নি মানুষটাকে।এই খচ্চরটার জন্য কিছু হচ্ছে না।এদিকে উচ্ছ তন্নির হাবভাব শুধু বোঝার চেষ্টাই করে যাচ্ছে।চাচাতো,মামাতো বোনদেরকে উচ্ছ খুব একটা পছন্দ করে না বললেই চলে।কারণ একেকটা যে হারে ন্যাকা।এইযে আজ কল্পনাকে দেখতে আসছে অথচ এরা একেকজন এমন সাজ দিয়েছে যেন আজ তাদেরই বিয়ের অনুষ্ঠান।চোখমুখ কুচকে উচ্ছ বলে,“ তুমি যাও এখন।”

“ ভাইয়া উৎস ভা…”

“ ওয়াশরুমে ঢুকেছে।কেন তোমারও যেতে ইচ্ছে করছে?”

তন্নি লাজুক হেসে ফেলে।এদিকে উচ্ছ ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে।তন্নির এমন হাসি তার মোটেও পছন্দ হয়নি।তন্নি হাত কচলাতে কচলাতে জবাব দেয়,“ না ভাইয়া এমন কিছু ইচ্ছে নেই।আমি আসি তাহলে।”

“ হ্যা হ্যা তাড়াতাড়ি যাও।”

তন্নি চলে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচে উচ্ছ।মুখে বলে ওঠে,“ অসহ্য।”

হঠাৎ করেই ড. আশিনের কথা মনে পড়ে যায় উচ্ছের।মেয়েটাকে প্রথম সে দেখেছিলো যেদিন ঢাকা থেকে গ্রামে আসছিলো।একটা ছোট বাচ্চা চোট পেয়েছিলো তা পরিষ্কার করে দিচ্ছিলো।আর উচ্ছ গাড়িতে বসে ছিলো।জীবনে কখনো কোনো মেয়েকে ভালো না লাগলেও ওই মেয়েটাকে ভালো লেগেছিলো তার।তবে আজ পর্যন্ত মুখটা ভালোভাবে দেখতে পেলো না উচ্ছ আশিনের।কারণ সবসময় মাস্ক পড়ে থাকে।ডাক্তার বলে নাকি কাউকে মুখ দেখাবে না ভেবে?উচ্ছ হঠাৎ সন্দেহ করে এই উৎস আবার আশিনকে হেনস্তা করে নি তো? এমনটাই হবে ভেবে উচ্ছ ঠিক করে উৎসকে আশিনের থেকে দূরে থাকতে বলবে।এমন ভাবনাতে গম্ভীর হয়ে ওঠে উচ্ছ। উৎস ওয়াশরুম থেকে বের হয় কিছুক্ষণ পর।উচ্ছ ভণিতা না করে বলে ফেলে,“ তুই কি ড. আশিনকে জ্বলাচ্ছিলি নাকি আজ?এমনটা যদি করে থাকিস তবে আমি বলবো তোর এটা করা মোটেও ঠিক হয়নি।মেয়েটার থেকে দূরে থাকিস।ওকে জ্বালাতন করা বন্ধ করবি।আমি যাতে পরেরবার না দেখি।”

উচ্ছের এসব লেকচার শুনে উৎস স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই জবাব দেয়,“ মেয়েটাকে বউ করার ইচ্ছে থাকলে সেটা ভুলে যা আমি কখনোই ভাইয়ের বউ মানতে পারবো না।দেখলেই মেরে ফেলবো.”

চোখ বড় বড় করে তাকায় উচ্ছ।তার হৃৎপিণ্ডটা হুট করে লাফাচ্ছে ভীষণ।বউ শব্দটা ভীষণ ভালো লেগেছে। তবে মেয়েটার ব্যাপারে এতটাও ভাবনামত্ত ছিলো না উচ্ছ।এখন মনে হচ্ছে ভাবা উচিত।উচ্ছ খুশিখুশি বলে,“ দেখা যাবে।আচ্ছা শোন তোকে বাবা ডেকে পাঠিয়েছে।”

“ কেন?”

“জানিনা” বলে উচ্ছ রুম থেকে বেরিয়ে যায়।উৎস তার বাবার সাথে দেখা করতে মোটেও ইচ্ছুক নয় তার চেয়ে ভালো ছাদে গিয়ে কয়েক প্যাকেট সিগারেট শেষ করা।

___

মেয়ের জন্য চিন্তায় চিন্তায় উঠোনে পায়চারি করছেন রবিন।মেয়েটা বলেছিলো তাড়াতাড়ি আসবে আজ। তবে এতো দেরি হচ্ছে কেন এই বিষয়ে ধারণা নেই তার।গেইট দিয়ে আশিনকে ভেতরে ঢুকতেই তড়িঘড়ি করে মেয়ের কাছে গিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে প্রশ্ন করে,“ কোথায় ছিলি মা?এতো দেরি হলো কেন?চিন্তা হচ্ছিলো খুব।”

আশিন ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপারে বলে না।বাবা চিন্তা করবে।ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলে,“ আসলে হাসপাতাল থেকে বেরোতে দেরি হয়েছে বাবা।ইমারজেন্সি ছিলো।”

রবিন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।আর কোনো প্রশ্ন করেন না।মেয়েকে তিনি বিশ্বাস করেন।

রাতে আশিন বাবার জন্য বাবার প্রিয় খাবার রান্না করে দেয়।খেয়েদেয়ে তার বাবা ঘুমিয়ে পড়ে।বাবার শরীরটা আজকাল বেশি ভালো থাকে না।বয়স বাড়ার সাথে সাথেই রোগ-বালাইয়ের অভাব থাকে না।বাবা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আশিন বারান্দায় গিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ।আকাশে থালার মতো চাঁদ উঠেছে আজ।দেখতে সুন্দর।আশিন ভাবে তাকে সামনের দিনগুলো ভালোভাবে কাটাতে হবে। বখাটেগুলো খারাপ সে জানে তবে মেয়েঘটিত খারাপের ব্লেইম শোনা যায়নি।তবুও নানাভাবে হেনস্তা করতে পারে তাকে।ভাবতেই ফোস করে শ্বাস নেই। ঝামেলা যেন লেগেই থাকে জীবনের সাথে।

___

হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে আশিন।আগমনী শীতের শীতল বাতাস গা ছুচ্ছে তার।এসবেরই মাঝে হঠাৎ একটা সুগন্ধ নাকে এসে লাগে তার।ঘ্রাণটা চেনা চেনা লাগলে থেমে এদিক ওদিক ঘুরে ঘুরে তাকাতেই পেছনে উৎসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আশিন।উৎসকে খুব সহজেই চিনে ফেলেছে সে।কারণ উচ্ছ আর উৎসের মাঝের পার্থক্যটা সে ধরতে পেরেছে।উৎসের চুলগুলো হালকা বাদামী রঙা আর উচ্ছের কুচকুচে কালো। উৎস অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।আশিন হাটা শুরু করে।উৎসও পেছন পেছন আসে তার।আশিনের হাটা থেমে যায়।পেছন ফিরে তাকিয়ে বলে,“ কি চাই?”

উৎস সহসা জবাব দেয়,“সরি হুনবার চাই।”

উৎস পরিবারের লোকজনদের সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বললেও অন্যান্যদের সাথে অশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে।

আশিন শুধায়, “কারণ?”

“গতকাল।বিনাদোষে চড় মারছো তাই।”

‘বিনাদোষ’ শব্দটা উচ্চারণ করে হেসে ফেলে আশিন। তবে সেটা মাস্কের আড়ালেই থেকে যায়।উৎস বলে,“ তুমি কি আসলেই ভয় পাওনা আমারে?তোমারে এনে মাইরা কাইটা ফালাইলেও কেউ টের পাইবো না।”

“মারতে পারবেন না আমায়।এত সাহস নেই আপনার।”

দুজন ছেলে আসে সেখানে।এরা গতকালও ছিলো উৎসের সাথে।ছেলেগুলো এসেই একজন আশিনকে ধমকে বলে,“ তুমি এহনি ভাইরে সরি কইবা।নয়তো তোমারে গ্রামছাড়া করুম আমরা।”

“ওহ তাই বুঝি! এতোই সহজ?”

উৎস আশিনের কাছে এসে আশিনের হাত মুচড়ে ধরে বলে, “মরবার চাও মাইয়া?সরি কইয়া যাও গা।ডিস্টার্ভ করুম না।এতো প্যাকপ্যাক করো কেন?”

হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে থাকে আশিন।তবে পারে না।রাগ দেখিয়ে চেচিয়ে বলে,“ছাড়ুন আমায়।আপনি কি পাগল?এতো খারাপ কেন আপনি?”

উৎস একদম তার সামনে। বিষয়টা মোটেও ভালো ঠেকছে না।আশেপাশে মানুষ না থাকলেও দু একজন আসা যাওয়া করছে তারা নিশ্চয় খারাপ ভাববে।এরই মাঝে কেউ এসে উৎসের হাত থেকে আশিনের হাত ছাড়িয়ে দেয়।আশিন হাফ ছেড়ে বাঁচে।ঘাড় কাত করে পেছনে তাকিয়ে দেখে উচ্ছকে দাঁড়িয়ে।উৎসের রাগ উঠে।তবে সেটা মুখের প্রকাশ পায় না।শুধু বলে,“ তোর উপস্থিতি আজকাল একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে।”

উচ্ছ আশিনকে চোখ দিয়ে ইশারা করে চলে যেতে বলে।আর উৎসের উদ্দেশ্যে বলে,“ ইন্টারেস্টেড জিনিসগুলোর মাঝে উপস্থিতি বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক।”

আশিন এদের মাঝে মোটেও থাকতে ইচ্ছুক নয়।সে উৎসকে চোখ রাঙিয়ে চলে যায়।এ গ্রামে থাকার মতো পরিবেশ নেই আর।বাবাকে বলে অন্যকোথাও চলে যাবে ভেবে ঠিক করে নেয় আশিন।আশিন চলে যেতেই শাওন উচ্ছকে বলে,“ ভাই তুমি এইডা কি করলা?মাইয়াদারে ছাইড়া দিলা কেন?ওরে জন্মের শিক্ষা দিতাম।”

“ হুশ ব্যাটা।এইসব ভুইলা যা।ওর দিকে তাকাইস না আর।”

“কেন তুমি কি তারে পছন্দ করো?”

পাশ থেকে উৎস ছোট করে বলে,“ হাহ পছন্দ।”

চলবে… …

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top