বাহারি স্বপ্ন [পর্ব-২.৮]

কোর্টে আজ একটা কেইস উঠেছে। বাংলাদেশের সিএমসি কোম্পানির বিরুদ্ধে। সরাষ্ট্রমন্ত্রী তামরুল রহমান এবং তার ছেলে তাওসিফ রহমানের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে নারী পাচার, মাদকদ্রব্য সাপ্লাই ও পাচার এবং খাদ্যমন্ত্রী ওসমান দেলোয়ারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠে এসেছে। তার ওপর সিএমসি কোম্পানির পুরোনো কর্মচারী অশোক তালুকদারের বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছে। এমনকি প্রমাণাদিসহ কিছুজন সাক্ষীও নাকি রয়েছে।
এদিকে সকাল থেকেই উরফান মহান অশোক তালুকদার আর আশিনকে ফোন করেই যাচ্ছে। তবে একটারও কোনো খোঁজ খবর নেই। তখনই অশোকের ছোট ভাইয়ের ছেলেটাকে দেখতে পেলো উরফান মহান। রূপক তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে। এসেই একটা হাসি দিলো রূপক। উরফান মহান দাতে দাত পিষলো। এসব ছোকরাদের তো মারা এক সেকেন্ডেরও ব্যাপার নয়। কিন্তু এখন ওদেরই উঁড়ার সময়৷ কিছুদিন উঁড়ুক না। বেশি উঁড়তে উঁড়তে যখন হাঁপিয়ে নীড়ে আসবে তখনই খপ করে ধরে ফেলবে উরফান মহান। তারপর বোঝাবে মজা। স্বয়ং নিজের বোন দুটোকেও ছাড় দেয় নি। বন্ধুটাকেও মেরে ফেলেছে। শুধুই কি তাই? যেই এই পথে তাদের বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সবগুলোকে উঁড়িয়ে দিয়েছে। রাজনীতির মতো শক্তিশালী দিক যদি পাশে থাকে তাহলে আর কি লাগে? আজকের কেইসটাও কি আর বেশিদূর এগোবে নাকি? এইতো কিছুক্ষণ মাত্র।
উরফান মহান জানেন এসব উৎসের একার কাজ নয়৷ পাশে কেউ তো আছে নিশ্চয়। আর বড় কথা হলো উৎস প্রমাণাদি পেলো-টা কোথায়? ও কি বেঁচে আছে? কই সকালে খবরের হেডলাইনে তো এমন কোনো সংবাদ পেলো না উরফান মহান। আর সিএমসির বিরুদ্ধের প্রমাণ তো এক বিজ্ঞানীর নিকট লুকায়িত ছিলো। বিজ্ঞানী ফেড্রিকের কাছে। ফেড্রিক তো গর্তে লুকিয়েছে। তাহলে ওকে তো পাওয়া সম্ভব না। আর বাকি রইলো আশিন। ও কি সব জেনে গেলো নাকি এ নিয়ে আবার ভয় পেলো উরফান মহান। কোর্ট থেকে যাবৎ জীবন জেল দিলেও তো বাঁচা যাবে, তবে আশিনের হাত থেকে তো বাঁচা অসম্ভব। কিন্তু জানবেই বা কিভাবে? সেই শুরু থেকেই তো সব প্ল্যানমাফিক চলছিলো। আশিনকে অশোককে নয় বরং উৎসকে মারার জন্য গ্রামে পাঠানো। রীতিমত গ্রামের সেই সাক্ষীগুলোকেও তো আশিন মেরে দিয়েছে। শুধু উৎসকে মারতে পারে নি। খুব বড়সড় ভাবনায় পড়ে গেলেন উরফান মহান। মেয়েটা যেই হারে নিঁখোজ হয়ে যায়। আবার কোনদিক না কোনদিক দিয়ে সত্যি জেনে যায় কে জানে? নাকি ওই রবিন সব বলে দিয়েছে? উরফানের খেয়ে আবার উরফানের সমস্ত তথ্যই যদি বলে দেয়? বুড়োটা তো মরে গেছে অবশ্য। মরার আগে সব বলে দিলে তো ঝামেলা। আশিনকেও দেখে দেখে রাখতে হবে এখন। উরফান মহানের এবার সেই ভাবনাটা মাথায় এলো। যেটা ২০১৬সালেই ভেবে রেখেছিলেন। আশিনের আবিষ্কার দিয়েই আশিনকে মারবেন তিনি। যেই সেই আবিষ্কার নয়। আশিনের দ্বারা বিশাল পাপ হয়েছে, আর সেই পাপ হলো তার তৈরি ভয়ানক এক জন্তু। যেটা মানুষের মতো শরীর হলেও মুখায়ব খুবই ভয়ানক। ল্যাবে ইনজেকশন দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় রাখা হয়েছে সেটা। অবশ্য সেই জন্তুর খোঁজ কেউ কখনও পাবে না।
“ কি ভাবছেন মি. উরফান?” রূপকের এমন ব্যাঙ্গ স্বর শুনে উরফান মহান রূপকের দিকে ফিরে তাকালেন। মনটা চাইলো একে এখানেই পুতে দিতে। দাতে দাত পিষে বলল,“ কি ভাবছি যদি বলেই দেই তাহলে পালানোর জন্য তো গর্ত খুঁজবি।”
হো হো করে হেসে উঠলো রূপক। একটু এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে ব্যাঙ্গ করে বলে উঠল,“ আপনি নিশ্চয়ই আপনার নিজের লুকিয়ে থাকার জন্য গর্ত খোঁজা নিয়ে ভাবছিলেন। তবে চিন্তা নেই, জেলে ভালোই থাকবেন। ফাঁসিতে ঝুলতে হলে তো আরও মারাত্মক। যা পাপ করেছেন। মরার পর গর্ত খুঁজে খুঁজে কুল পাবেন না।”
উরফান মহান মারার জন্য এগোতেই উশান বাবাকে থামিয়ে দিলো। তখনই সেখানে সরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে তাওসিফ এলো। রূপকের কাঁধে হাত রেখে বলল,“ কার লেজে পা দিচ্ছেন বুঝতে পারছেন তো অফিসার?ʼ
বেশি কথা বলা তাওসিফের পছন্দ নয়৷ আবার এরা যা ধূর্ত অফিসার। কখন আবার কি না কি রেকর্ড করে ফেলে। বেশ নামকরা উকিলকে নিয়েই কোর্টের ভেতরে প্রবেশ করলেন উরফান মহানসহ তাওসিফরাও। রূপক বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। উৎস আসবে-টা কখন?
উৎসকে ফোন করতে নিলেই কাঁধে কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে ঘুরে তাকালো রূপক। উৎস আজ নিজের পেশাদার পোশাকে দাঁড়িয়ে। উকিলটাকে এতদিন সাধারণ পোশাকে বোঝাই যেতো না এই ছেলেটাও উকিল। অথচ দেখো আজ কেমন একটা গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উৎস হাঁটা ধরলো সামনে। রূপক ‘বেস্ট অফ লাক’ বলে উঠলো।


বাইরে ঝড়ের আভাস। ঠান্ডা হাওয়ায় গা ছমছমে অবস্থা। তারওপর বাড়িতে যদি সাক্ষাৎ সেই প্রলয়কারী ঝড়টা চলে আসে, তাহলে হার্ট অ্যাটাক করে যে মারা না যাওয়া এটাই তো ভাগ্য। উপহাসরা তখন দলাপাকিয়ে নেচে বেড়ায় আনাচে কানাচে। এত ক্ষমতাধর হওয়া স্বত্তেও এক নারীকে ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে বসে থাকাটা কতটা শৌখিন? সেটা আপাতত ওসমান দেলোয়ারের মাথায় আসছে না। পাশে বডিগার্ডরা দাঁড়িয়ে বন্দুক তাক করে আছে আশিনের দিকে। এদিকে আশিন নির্ভয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। পুরো বাড়ি এত সিকিউরড, এত এত কড়া পাহারায় থাকা স্বত্তেও ভয়েরা বার বার বেরিয়ে আসতে চাইছে ওসমান দেলোয়ারের।
আশিন হুট করেই উঠে দাঁড়ালো। আশিনের এমন উঠে দাঁড়ানোতে ওসমান দেলোয়ারও একপ্রকার লাফিয়ে উঠলো। বডিগার্ডদের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো আশিনের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। চোখ রাঙালেন ওসমান দেলোয়ার। ফিসফিসিয়ে বললেন,“ এই মেয়ে মানুষ নয়। ঝড়ের গতিতে এসে যখন গলা কেটে দেবে তখন বন্দুক তাক করা বেরিয়ে যাবে তোমাদের। ”
বডিগার্ডরা এবার বন্দুক নামিয়ে নিলো। এদিকে আশিন তখন অন্যদিকে গিয়েছে। পুরো বাড়ি এদিক ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আজ তো কোর্টে এদের ব্যাপারে একটা কেইস উঠেছে। কিন্তু লোকটা ওখানে না গিয়ে বাড়িতে বসে বসে নারীসঙ্গ করছে। বাপ রে! কি কলিজা এদের। আশিন এক দলা থু থু ফ্লোরে ফেলল এসব ভেবে। ছি!
এদিকে ওসমান দেলোয়ার সেদিনের আশিনের হঠাৎ আক্রমণের কথা মাথায় আসতেই আবারও ভয় পেয়ে গেলো। উরফান মহানের থেকে জেনেছেন এই মেয়ের ভয়াবহতা। কিছু করতেও পারবেন না। একে মারলে উরফান মহান আবার তাকে মারবেন। আবার এই আশিনই যদি মেরে ফেলে? বোধহয় মারবে না। ওসমান দেলোয়ার ভাবলেন উরফান মহানকে বলবেন এই মেয়েকে দ্রুত পথ থেকে সড়িয়ে দিতে। মীরজাফরি করতে কতক্ষণ এই মেয়ের?
“ আমার ব্যাপারে ভাবা বাদ দিয়ে এবার ভালোই ভালোই তোর পাঞ্জাবির পকেটে থাকা চাবিটা আমার হাতে দে।”
আশিনের ঠান্ডা কণ্ঠস্বর অথচ ওসমান দেলোয়ারের কানে সিসা ঢেলে দেওয়ার মতো অনুভুতি হলো। মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলতে চাইলো,“ কোন চা…”
“ বের করবেন নাকি আমিই গিয়ে দরজাটা ভাঙবো? ”
ওসমান দেলোয়ার ঘাবড়ে গেলেন। এই চাবি যদি একবার পড়ে যায় তাহলে সকল কুকর্ম ফাঁস হয়ে যাবে। আশিনের বিরক্তি বাড়লো এদিকে। আর কোনো কথা না বলে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে এলো। তার হাতে থাকা ব্যাগটা আনতে ভুললো না। ব্যাগে যে খুবই প্রয়োজনীয় এক জিনিস নিয়ে ঘুরে বেড়ায় মেয়েটা। ওসমান দেলোয়াররাও আশিনের পেছন পেছন বেরিয়ে এলো। এদিকে আশিন এগিয়ে গেলো ওসমান দেলোয়ারদের সেই চালের বস্তা রাখার ঘরটার দিকে। ঘরটা কিছুটা অতিরিক্ত গাছগাছালির মাঝে অবস্থিত। এদিকে ঘাবড়ে গেলেন ওসমান দেলোয়ার৷ এটা কিছুতেই করতে দেওয়া যায় না। এই ভেবে কিছুজন বডিগার্ডদের পাঠিয়ে দিলেন আশিনের পিছু পিছু। মেয়েটা যদি এখন বেশি বাড়াবাড়ি করে তাহলে খুলি উঁড়িয়ে দেবে। উরফান মহানের সাথে কথাবার্তা পরে হবে। তবে এরই মাঝে ওসমান দেলোয়ারের পাঠানো বডিগার্ডগুলোর সামনে কিছুজন লোক এসে দাঁড়ালো। ওসমান দেলোয়ারের চোখ বেরিয়ে আসার জোগাড়।
আশিন হঠাৎ চলন থামিয়ে দিয়ে পেছনে ঘুরে তাকালো। মুচকি হাসতে হাসতে তার সেই ব্যাগটা থেকে ধারালো এক ছুরি বের করলো। এটা দেখেই খুব ভয় পেয়ে গেলেন ওসমান। চোখ গেলো আশিনের পাশে কোথা থেকে চলে আসা উচ্ছর দিকে। এই ছেলেও কি মিরজাফরি শুরু করেছে নাকি ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ওসমান চিৎকার করে উঠলো। তড়িৎ বেগে মস্তক ঘুরিয়ে পেছনে চাইলো। বিশাল বড় কাঠের দরজাটায় ছুরিটা গেঁথে আছে। এই ছুরিটাই তো ওই আশিন বের করেছিলো। ওসমান দেলোয়ার বুকে এক হাত দিয়ে মুখে এক হাত দিয়ে ঘাম মুছতে লাগলেন। বডিগার্ডদের সড়ে আসার নির্দেশ দিলেন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে। আশিন এবার সামনে এগিয়ে গেলো। এক ছেলে এসে আশিনকে একটা কুড়াল দিয়ে গেলো। ওসমান দেলোয়ার এইটা ভেবে পাচ্ছেন না এই এতো লোকজন তার বাড়িতে আসলো কোথা থেকে। তখনই আশিনের হাতে সেই কুড়ালটা দেখে আরও বেশি ভয়ে তটস্থ হয়ে রইলেন ওসমান।
আশিন কুড়াল দিয়ে কাঠের দরজায় আঘাত করতে যাবে এমন সময় উচ্ছ বলে উঠলো,
“ পাশেই উচ্ছ দাঁড়িয়ে আছে।তো এতো কষ্টের কি দরকার? ”
বলেই কিছুজন লোককে ডাকলো উচ্ছ। এদিকে ওসমান দেলোয়ারের কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে অবিরত। তিনজন লোক এসে দরজাটা ভেঙে ফেললো। আর তখনই ভেসে এলো ভেতরে থাকা অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েদের বিভৎস চিত্র। চোখ নামিয়ে নিলো উপস্থিত সকলে। আশিন এগিয়ে গেলো ভেতরে। উচ্ছকে ডাকলো আশিন,“ উচ্ছ!”
উচ্ছ এগিয়ে এলো না। বাইরে থেকেই সাড়া দিলো। আশিন বলে উঠলো,“ মেয়েদেরকে নিরাপদে সড়ানোর ব্যবস্থা করো।”
আশিন বেরিয়ে এলো। উচ্ছ সমস্ত ব্যবস্থার জন্য কাউকে কল দিলো। কিছুক্ষণ পর একটি পুলিশ ফোর্স এলো সেখানে। ওসমান দেলোয়ারকে গ্রেফতার করা হলো। সাথে করে ফাঁস হলো তার সমস্ত অবৈধ ব্যবসা সম্পর্কে।
“ সবদিকেই এতো খেয়াল। আমার দিকেও তো একবার ফিরে তাকাতে পারো আশিন।”
উচ্ছর কথায় আশিন উচ্ছর দিকে ফিরে তাকালো। বললো,“ তাকালাম।”
“ এই তাকানো সেই তাকানো না।”
“ বাজে বকা বন্ধ করো। ”
উচ্ছ কিছু বলতে চাইলো আবারও। তবে আশিনের ফোনে সেই মুহুর্তে কল এলো। লাউড স্পিকারে দেওয়া থাকায় ওপাশ হতে খবর এলো,
“ উরফান মহান আর সরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিপক্ষের মামলা বেকসুর খালাস ঘোষণা করা হলেও ওসমান দেলোয়ারকে যাবৎ জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”
আশিন ফোনটা কান থেকে সড়ালো। বেকসুর খালাস শব্দটা বার বার কানে বাজতে লাগলো। তার বাবা মায়ের নির্দোষ প্রমাণের কেইসটাও এভাবেই বেকসুর খালাস রায় দেওয়া হয়েছিলো। আশিন মাথা নামিয়ে একটু হাসলো। শান্ত আওয়াজে বলে উঠলো হঠাৎ,
“ কোর্ট থেকে এই রায় পাওয়া নিতান্তই স্বাভাবিক৷ তবে আমার আদালত যে অন্য রায় ঘোষণা দিলো।”
চলবে,..

  • Junani CH

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top