এই পাহাড়টা আমার কবর হতে পারত… এখন এটাকেই আশ্রয় বানাতে চাই।” পেখম জানে সে পাখি ছিল। উড়তে পারত, স্বপ্ন দেখত। অথচ এখন জীবনটা যেন ঘরবন্দি এক খাঁচার গল্প, যেখানে প্রতিটি বার্স্ট ওয়াউন্ড, প্রতিটি আঘাত তার ডানায় লেগেছে। কেউ জানে না, সে কতটা চেয়েছিল ভালোবাসা, চিরস্থায়ী, স্পর্শহীন বিশ্বাসে ভরা ভালোবাসা। কিন্তু সে ভালোবাসার বদলে পেয়েছে, প্রতারণা, একজন স্বামীর নোংরা আধিপত্য, রক্তাক্ত শরীর আর আতঙ্কে পেঁচানো রাত, অবাঞ্ছিত স্পর্শ, জমজ সন্তান হারানোর অসমাপ্ত মা হয়ে বেঁচে থাকা, হাসপাতালের সাদা চাদরে নিজেকে মৃত মনে হওয়া, স্ট্রোক, পরিবাবরের সবার কাছে মিথ্যা বলেছে সৌজন্য এবং তারপর, ডিভোর্স পেপারে নিজের স্বাক্ষরহীন স্বাক্ষর। পেখম হয়তো ডক্টর হতে চেয়েছিল। মানুষের শরীর সারাবে বলে। কিন্তু এখন সে নিজের মনটাই সারাতে পারছে না। কিন্তু সে হার মানেনি। সে ম’রে যেতে আসেনি সাজেক, সে বাঁচতে এসেছে। পেখম নিজের ভিতরে নিজেই বিরবির করে বলে ওঠে, “আমি তো লুজার না! আমি জোর করে বাঁচবো, কারো জন্য না, নিজের জন্য।” তাকে কেউ বাঁচায়নি। না তার মা, না সমাজ, না আইন। সে নিজেই নিজেকে এখন তুলে নিচ্ছে নিজের কাঁধে করে। পাহাড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে, বাতাসে চোখ বুজে, ফের বলল, “এবার আমি কারো বউ নই, কারো মালিকানাধীন শরীর না। আমি শুধু আমি। আমি পেখম। পেখম নূরাইন পলক। ”
—– পেখম এক ঘুম দিয়ে উঠে দেখল, সকালের সূর্য পাহাড়ের চূড়ায় খেলছে। পেখম রুম থেকে একটা হট কফি হাতে নিয়ে চলে আসে ওপেন ডেকের কাঠের বেঞ্চে। সেখানে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে বাহিরে স্তব্ধের মতো অনেকটা সময় তাকিয়ে থাকে। দেখতে ভালো লাগছে। কেন লাগছে পেখম জানে না। তবে এই সময়টা এখানে থমকে গেলে হয়ত ভালো লাগত। রুমের দরজায় নক পড়তেই পেখমের ভাবনা ভাঙ্গে। তাই উঠে রুমে এসে দরজা খুলতেই হোটেলের ম্যান্জারকে দেখে সৌজন্যেমূক মৃদুহাসে তারপর জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবেন?” লোকটা আমতাআমতা করল তারপর বলল, “একচুয়ালি মিস, আমাদের একটা ভুল হয়েছে। এই রুমটা আপনার নয়! একই সময় রুম বুকিং হওয়ায় আমরা একটু গরবর করে ফেলেছি। আপনার রুমটা এই রুমের পাশের রুম।” পেখম কপাল কুঁচকায়। এতো সেনসেটিভ বিষয এমন হেয়ালি যেন পছন্দ হল না। এই রুমটা পেখমের পছন্দ হয়েছে কিন্তু এখন বলছে এটা পেখমের রুম না? পেখম নিজেকে শান্ত করে বলল, “আচ্ছা, সমস্যা নেই। এই রুম আর ওই রুম তো পার্থক্য নেই। এটা যার রুম তাকে ওই রুমটা দিয়ে দিন!” “আসলে ম্যাম… আপনি হয়ত বুঝতে পারছেন না…!”
এভাবেই চলল তাদের মাঝে বাকবিতন্ডা। শেষে পেখম বিরক্ত হয়ে বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। চাবি দিন। আমিই যাচ্ছি!” এটা বলে বেশ বিরক্তির সাথে রুমে ঢুকে নিজের জামাকাপর আবারো লাগেজে নিয়ে বেড়িয়ে আসতেই লোকটা একটা চাবি এগিয়ে দিল। চাবি নিতেই লোকটা চলে গেল। তারপর নিজের লাগেজ টেনে পরের কটেজের সামনে যেয়ে লকে চাবি ঢুকিয়ে লক খুলে কি মনে করে অন্যপাশে তাকাতেই মনে হল, পরিচিত কোনো লোককে একটু আগের রুমে ঢুকতে দেখল। সাথে সাথে কপাল কুঁচকায় পেখম। এখানে পরিচিত মানুষ আসবে কোথা থেকে? ততক্ষনে তার রুমের দরজা খুলে গেছে। রুমের মধ্যে লাগেজ তুলে নিজেও ঢুকল রুমে। শরীরের কালো লেদার জ্যাকেটটা খুলে আবারো বিছানায় ফেলে একটা শ্বাস ফেলল সাথে সাথেই মনে হল, তার আগের পাশের রুমে যে উঠেছে তাকে পেখম চেনে। একসাইড দেখে তাই মনে হয়েছে পেখমের তাই নিজের জানার আগ্রহ দমাতে না পেরে নিজের জ্যাকেটটা তুলে নিয়ে নিজের শরীরে জড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে আগের কটেজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে এদিকসেদিক তাকিয়ে দরজায় নক করে। খানিক অপেক্ষার পর কেউ দরজা খুলল, তবে অপ্রত্যাশিত ভাবে দরজার বিপরীতে থাকা অর্ধউন্মুক্ত শার্টলেস মানুষটিকে দেখে হতভম্ব হলো পেখম, থেমে থেমে অবাক গলায় বলল, “আ-আ, নওশির আবে? সিজ… বুড়াদা মিসিনিজ?!” [“A-aa, Nawshir Abi? Siz burada mısınız?!” – “আরে, নওশির ভাই? আপনি… এখানে!” ] তার গলায় হতভম্ব ভাব স্পষ্ট। নওশির শান্ত চোখে পেখমকে দেখল তবে বিনা প্রতিক্রিয়ায় গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বলল, “ইচেরি বুয়ুরুন।” [“İçeri buyurun – ভেতরে আসুন!”] পেখম মাথা নাড়ল তারপর আবারো করিডোর দেখে নওশিরের পেছনে পিছনে তার কটেজে ঢুকল। নওশির রুমে ঢুকে আগে শার্ট তুলে তা শরীরে গলিয়ে নিল। পেখম এতোটা সময় কিছু মনে না করলেও যখন খেয়াল এলো যে নওশির এতোটা সময় উন্মুক্ত শরীরে ছিল আর সে এভাবে রুমে ঢুকেছে ভাবতেই মুহুর্তেই লজ্জা ঘিরে ধরল তাকে। তবুও চুপ করে রইল পেখম। নওশির পিছনে ফিরে আবারো পেখমকে বিছানা দেখিয়ে বলল, [“Oraya oturun — ওইখানে বসুন”] “ওরায়া ওতোরুন।” বিছানার দিকে তাকাল পেখম। তারপর আবারো নওশিরের দিকে তাকাল। তার এতোটা ধৈর্য হচ্ছে না। তাই সেও জেদ দেখিয়ে বলল, (“Oturun, ama önce söyleyin… burada ne arıyorsunuz?” ওতুরুন, আমা ওনজে সোইলেইন… বুড়াদা নে আরিইয়রসুনুজ?) “বসব, তবে তার আগে বলুন… আপনি এখানে কী করছেন?” শীতল চোখে তাকাল নওশির। তার ছাইরংয়ের চোখ গুলো কেমন করে যেন উঠল শান্ত গলায় ফের আদেশ করল, “আগে বসুন, তারপর বলছি।” ( “Önce oturun, sonra anlatacağım.” — ওনজে ওতুরুন, সোনরা আনলাতাজাকাম।) আর কোনো প্রশ্ন করল না পেখম। ঢোক গিলে বিছানায় যেয়ে বসল। নওশির তা দেখে ওয়াশরুমে চলে গেলো। তারপর ওয়াশরুম থেকে বের হলো খানিক সময় বাদে। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছে। হাতের টাওয়াল দিয়ে হাত মুছে ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে মুখ ক্লিন করে পেখমের দিকে তাকাল। পেখম বের অস্বস্তিতে ভুগছে। হুট করে ছয়বছর পড় নওশিরকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে। নওশিরের মুখে তেমন কোনো অভিভক্তি নেই। সে এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে পেখমের সামনে বসল। তাতেই পেখম একটু নড়েচড়ে বসল। তারপর নওশিরের দিকে তাকায়, নওশির শীতল চোখে এখনো পেখমের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারপর ধীর গলায় আধভাঙ্গা বাংলায় জিজ্ঞেস করে, “আপনার ডিভোর্স হয়ে গেছে?” চমকায় পেখম। থমকে ভরকানো মুখে নওশিরের দিকে তাকিয়ে আছে। কেমন আছে, কি হয়েছে এতো সকল প্রশ্ন, পেখমের করা প্রশ্ন সব উপেক্ষা করে সে এই প্রশ্ন করল কেনো? আর সেই বা কি করে জানল পেখমের বিয়ে হয়েছিল, বা হয়েছে? আবার ডিভোর্সও হয়েছে? চমকানো গলায় বলল, “নওশির ভাই?” “যা জিজ্ঞেস করেছি, শুধু তার উত্তর বলবেন।” ছলছল করে উঠল পেখমের চোখ। এতোদিন পর দেখা হবার পর এতো প্রশ্ন থাকার পরও সে এই প্রশ্ন করল? ঢোক গিলল তারপর মাথা নাড়ায়, কিছু বলল না নওশির। শরীর ছেড়ে এলিয়ে দিল চেয়ারে তারপর পায়ের উপর পা তুলে আবারো আধোবাংলায় জিজ্ঞেস করে, “ছোট মা কেমন আছে?” “ভালো।” এককথায় জবাব দিল তারপর আবারো তাকিয়ে নওশিরকে উদ্দ্যেশ করে জিজ্ঞেস করে, “আপনি কেমন আছেন? বাড়ির সবাই কেমন আছে? দিদুন আর বড় মা কেমন আছে?” শীতল চোখে পেখমের উচ্ছ্বসিত মুখ দেখল। সে ভীষণ আগ্রহে তাকিয়ে আছে নওশিরের দিকে, নওশির শান্ত চোখে তাকিয়ে নির্বিকার গলায় বলল, “দিদুন মা-রা গেছে!” চমকায় পেখম। এলোমেলো দৃষ্টি নিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করল, “বড় বাবা?” চোখ ছোট করে জবাব করল নওশির, “তাকে দিয়ে আপনি কি করবেন? তার প্রতি তো আপনার মায়ের বেশ রাগ! আপনারও তো রাগ থাকার কথা তাই তো ছোটমা’র সাথে তুর্কী ছেড়ে এখানে এসে পড়েছেন। এখানে এসে ঠিক মতো পড়াশোনা না করে বিয়ে করলেন, আর সেই লোক ও… আর কিছু বলল না নওশির। পেখম দারুণ অপমানিত বোধ করল। নওশির পেখমের চাচাতো ভাই। মায়ের রাগ ও জেদ এর কারণে বাবা মারা যাবার পর তুর্কী ছাড়ল। পেখমের যখন ষোলো বছর তখন বাংলাদেশ নানুবাড়ি চলে আসে পল্লবী বেগম তারপর আর দাদুবাড়ীর কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করেনি তারা। তারপর এতোগুলো বছর পর, মোট কত বছর? দীর্ঘ ৬ বছর পর দাদুবাড়ির সব থেকে গম্ভীর কাজিনের সামনে পড়ল। আচ্ছা নওশির তুর্কী থেকে বাংলাদেশ এসেছে কবে? বাংলা শিখল কবে? আর সাজেকেই কেন এলো সে… দেখাটা কি কোনো কোএন্সিডেন্স নাকি … আর কিছু ভাবতে পারল না পেখম….
চলবে…
- প্রানেশা আহসান শীতল