পেখম এখনো বিছানায় স্তব্ধের মতো বসে আছে। নওশিরের মাঝে তেমন কোনো হেলদোল নেই। সেও পেখমের দিকে তাকিয়ে আছে নীরব দৃষ্টিতে। পেখম ঢোক গিলল তারপর বলল,
‘বললেন না তো বাংলাদেশে এলেন কবে?’
‘এটা জানা কি খুব দরকার?’
‘না জিজ্ঞেস করলাম।’
‘তাহলে পড়ে বলব।’
আর কিছু জিজ্ঞেস করল না পেখম। আবারো নীরবতা নেমে এলো। খানিক সময় চুপ থেকে পেখম ফের জিজ্ঞেস করল,
‘নূরিশা কেমন আছে?’
‘ইন্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ছে!’
‘ওহ!’
‘হু!’
শ্বাস ফেলল নওশির তারপর তীর্যক গলায় জানতে চাইল,
‘আপনি পড়ালেখা ছেড়ে দিলেন কেনো?’
সে কথার জবাব পেখম দিলো না। উল্টো জিজ্ঞেস করল,
‘আমার বিয়ে, ডিভোর্স আর ওসব খবর আপনি জানলেন কি করে?’
পেখমের নির্বুদ্ধিতায় হাসল নওশির। তারপর বলল,
‘আপনারা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছেন, আমরা নই। তাই হয়ত একটু হলেও খবর রেখেছি।’
চুপ হয়ে গেলো মেয়েটা। খানিক সময় পর ফের বলল,
‘আচ্ছা থাকুন। আমি রুমে যাই।’
নীরব চোখে সম্মতি জানাল নওশির। পেখম বিছানা থেকে নেমে দরজার সামনে দাড়িয়ে যেয়ে থমকালো তারপর পিছনে ঘুরে বলল,
‘আপনার নম্বরটা দেয়া যাবে নওশির ভাই?’
‘শিউর!’
তারপর নম্বর দিলো নওশির। পেখম নম্বর সেভ করে নওশিরের দিকে তাকাল তারপর জিজ্ঞেস করল,
‘কতদিনের জন্য আছেন এখানে?’
‘ভাবিনি!’
অবাক হয় পেখম তারপর শুধায়,
‘প্ল্যান ছাড়া কেউ ঘুরতে আসে?’
‘মন চাইলেই আসা যায়।’
নওশিরের কথার জবাবে পেখমও হুট করে বলল,
‘না এলে এভাবে দেখাও হতো না তাই না?’
জবাব করল না নওশির। পেখমের অবশ্য মন খারাপ হয় নি। নওশির আগে থেকেই এমন। সে বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। তবুও যে এতো কথা বলেছে এই অনেক। দিদুনের জন্য পেখমের ভীষণ মন খারাপ হয়েছে। পেখম আবারো ঘুরে দরজায় হাত রাখতেই পিছন থেকে নওশির পেখমকে ডাক দেয়,
‘পেখম?’
অবাক মুখে ঘুরে তাকায় পেখম। নওশির শীতল গলায় আদেশসংবলিত গলায় বলল,
‘আমার সাথে দেখা হয়েছে বা কথা হয়েছে তা ছোট মাকে বলার দরকার নেই!’
পেখমেরঅবাক যেন শেষ হলো না। কপাল কুঁচকে জানতে চাইল,
‘কেন?’
‘সব কেনোর উত্তর হয় না পেখম। এখন আপনি আসুন!’
কথা এখানেই শেষ করে নওশির তারপর বিছানায় উঠে যায়। পেখম দেখল সাথে বুঝল জার্নি করায় হয়ত এখন সে রেস্ট করবে। তাই আর কিছু না বলে ধীরে নওশিরপর কটেজ থেকে বেড়িয়ে গেলো। পেখম যেতেই শ্বাস ফেলল নওশির। মেয়েটা সেই ছোট বেলার মতই শান্ত আর বোকাই রয়ে গেছে। এসব ভাবতে ভাবতেই বালিশে মুখ গুঁজে চোখ বন্ধ করে রইল নওশির।
~~
পেখম রুমে এসে পায়চারি করল। হুট করে নওশিরকে এখানে সে কখনোই কল্পনা করেনি। তাহলে এখানে কেন সে? আর তার কথা বলার টোনটাও কেমন! যদিও নওশির দাদাবাড়ীর প্রথম ছেলে যে কিনা ভীষণ গম্ভীর পদের। নওশির পেখমের বাবার ভীষণ নেওটা ছিলো তবে বাবার মৃতুর পর যেন নওশির একদম শান্ত হয়ে গেলো কিন্তু পেখম আজও জানে না মা কেনো বড় বাবার সাথে রাগ করে ওই বাড়ী ছেড়েছে। কোনোই বা ওইবাড়ির কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে দেয় নি আর না রেখেছে।
নওশিরও পেখমকে তার মাকে নওশিরের ব্যপারে জানাতে বারণ করেছে! কি এমন হয়েছে? পেটের ভেতর ভীষণ ঘুটঘুট করছে। কি হয়েছে? কি এমন হয়েছে?
রুমের দরজায় নক হলো। চমকালো পেখম তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দরজা খুলল। নওশির দাঁড়িয়ে আছে। পেখম কিছু বলার আগেই নওশির ধীরে বলল,
‘নূরিশা আপনার সাথে কথা বলবে!’
মনে মনে একটু ভরকায় পেখম। তবুও দরজা থেকে সরে দাঁড়াতেই নওশির নির্বিকার ভাবে রুমে প্রবেশ করে। সে রুমে ঢুকতেই পেখম রুমের দরজা আটকে দিয়ে নওশিরকে বলল,
‘তাহলে তো বড় মা আর বড় বাবার সাথেও কথা বলতে পারব, তাই না?’
‘না!’
এককথায় জবাব দিতেই পেখম থতমত খায়। সাথে মুখের উপর এভাবে না করায় একটু অপমানিত বোধ করল। নওশির পেখমের মুখ পর্যবেক্ষণ করে ফের শুধাল,
‘নূরিশা হোস্টেলে থাকে। তাই ওর সাথেই কথা বলতে পারবেন!’
সাথে সাথে মুখে হাসি ফুটল পেখমের। তারপর বলল,
‘ওহহ হো, তা আগে বলবেন না! আচ্ছা দ্রুত কল দিন। আমি নূরিশাকে দেখার জন্য ভীষণ এক্সাইটেড।’
পেখম এতোটুকু বলতেই নওশির কে
নির্লিপ্ত-ভাবে ফোন বের করে কল দেয় নূরিশার নম্বরে। মুহুর্তে অতিক্রম করতেই কল রিসিভ হয় বিপরীতে থেকে। নূরিশা নওশিরের সাথে খানিক কথা বলে পেখমের কথা জিজ্ঞেস করতেই, নওশির শান্ত চোখে পেখমের দিকে তাকায়। যেন সে নীরবে সম্মতি চাইছে। পেখম ঢোক গিলল তারপর চোখের পল্লব ফেলে অনুমতি দিল। নওশির ফোন এগিয়ে দিল। পেখম মিষ্টি হেসে ফোনটা নিল। নূরিশা পেখমকে দেখে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। পেখমও চুপ করে বোনকে দেখছে। এই বোন তার খেলার সাথী, সমবয়সী, বান্ধবী। আর তার সাথে এতোটা বছর পর দেখা। পেখমের চোখ ছলছল করে উঠল। নওশির পেখমকে দেখছে। পেখম চোখ সরিয়ে নিয়ে ঢোক গিলে কান্না গিলে তুর্কী ভাষায় বলল,
‘কেমন আছ নূরিশা?’
নূরিশা ভুবনভোলানী হাসি তুলল ঠোঁটে তারপর বলল,
‘আমি ভালো। তোমায় দেখে আরো ভালো লাগছে। কখনো ভাবিনি তোমায় আবার দেখব।’
‘আমিও!’
তারপর আবারো নিরবতা নামে তাদের মাঝে। যেন কোনো জড়তার দেয়াল উঠেছে তাদের মাঝে।নওশির পেখমের মুখ দেখছে। সে উদ্বিপনায় কাঁপছে। তা ফোনের ওপরে বুঝা না গেলেও নওশির বুঝতে পারছে। পেখম আবারো জড়তা নিয়ে নূরিশার সাথে কথা শুরু করল। সাথে চোখ পড়ল নওশির উপর, যে কিনা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পেখম এটা তেমন একটা আমলে নিলো না উল্টো এগিয়ে এসে বলল,
‘নওশির ভাই বিছানায় বসুন!’
নওশির নড়ল না। এখনে দাঁড়িয়ে আছে। তাই পেখম নওশিরের হাত ধরল। নওশিরপর ভাবনা ভাঙ্গল। পেখম আবারো বলল,
‘বিছানায় বসুন নওশির ভাই।’
নওশির তেমন প্রতিক্রিয়া করেনি। ধীরে নরম পায়ে এগিয়ে বিছানায় বসল। তা দেখে পেখম আবারো ফোনে মনোযোগ দিল। নূরিশার সাথে কথোপকথনটা প্রথমে ছিল কিছুটা জড়তা মেশানো, কিন্তু ধীরে ধীরে তা উষ্ণ হয়ে উঠতে লাগল। দুই বোন যেন শব্দ মালায় নয়, চোখ দিয়ে কথা বলছে। পেখম মাঝে মাঝে কথা থামিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে স্ক্রিনে থাকা বোনটার মুখে। নূরিশা পেখমকে দেখে শান্ত স্বরে বলল,
‘তুই অনেক শুকিয়ে গেছিস। তোকে আর আগের মতো লাগে না পেখম।”
পেখম নীরব হয়। কিছু বলার থাকে না তার কাছে। তারপরও হাসল আর ধীরে বলল,
‘সব কিছু কি সব সময় ঠিক থাকে? দেখবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
নূরিশা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, চোখে পানি জমে যেন তা গড়িয়ে পড়তে ছাইছে। আবদারের গলায় বলল,
‘তোকে আবার জড়িয়ে ধরতে চাই। একবার… শুধু একবার। আমাদের আবার কবে দেখা হবে পেখম?’
নওশির এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল, তার চোখে কোনো আবেগ ছিল না, কিন্তু হঠাৎ চোখ নামিয়ে ফেলল। যেন কোনো স্মৃতি তাকে ছুঁয়ে গেল। পেখম চোখের জল চাপা দিতে দিতে বলল,
‘আমি তোর কাছেই যাব। তোকে দেখে তোর চুলে হাত বুলিয়ে বলব—– আমি আছি রে নূরিশা, তোদের ছেড়ে যাইনি। আমাদের আবার দেখা হোক … খুব দ্রুত দেখা হোক! নূরিশা বোন আমার!’
নূরিশা কাঁপা গলায় বলল,
‘ছোটমাকে বলবি না?’
পেখম চুপ করে গেল। নওশিরও চুপ। ফোনের স্ক্রিনের দুই প্রান্তে যেন একসাথে গিলে ফেলা হল একখণ্ড কান্না। নূরিশা কান্না থামিয়ে বলল,
‘আমার জানার দরকার নেই কেন ছোট মা এমন করল। কেন তোকে আমাদের থেকে আলাদা করল। আমি শুধু চাই, তুই আবার আমাদের হয়ে যা।”
পেখম হেসে ফেলল তারপর বলল,
‘আমি আসব নূরিশা। প্রমিজ করছি।”
এমন অনেক কথা বলল দুই বোন, যেন হাজার বছরের কথা জমা তাদের। কথা শেষ করে পেখম ধীরে ফোনটি ফেরত দিল নওশিরকে। তার চোখ ভিজে, মুখটা শান্ত। নওশির ফোনটি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে পেখম নওশিরকে বলল,
‘নূরিশার নম্বরটা দেবেন?’
নওশির কিছু বলল না। নূরিশার নম্বরটা দিয়ে মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পেখম জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। হঠাৎ নিজেকে হালকা লাগছিল তার।
সে জানত না, এই সফরের শেষে সে কী নিয়ে ফিরবে, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারছে। অভ্যন্তরের জমে থাকা স্তব্ধতা আস্তে আস্তে গলছে। সেদিন রাতের ঘুম যেন তার কাছে এতোদিনের বহন করা কষ্ট কমিয়ে এনেছে। তাই রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সে ব্যাগ থেকে তার সেই ডায়রীটা বের করল এবং ডায়েরিতে লিখল~~
‘আজ অনেকদিন পর বুকের ভেতর কিছু তা স্বস্তিতে নড়ে উঠল। নূরিশাকে দেখেছি। আর দেখেছি নওশির ভাইয়ের চোখ। যেখানে অস্পষ্ট এক আড়াল জমে আছে। তাদের দেখে খুব ভালো লাগছে, তাবে নওশির ভাইয়ের চোখে কি একটা ছায়া ছিল, জড়তা ছিল। কিন্তু কি সেই জড়তা?’
—
চলবে…