বৃষ্টি হয়ে নামো [পর্ব-০৫]

রাত আট টা ত্রিশ নাগাদ তখন।ঠান্ডা হিমহিম বাতাসে সায়ন,ঊর্মি,ধারা,দিশারি বিভোরের জন্য অপেক্ষা করছে।ধারার গায়ে লেদারের ব্ল্যাক জ্যাকেট।দিশারি-ঊর্মি শাল পরেছে।তাঁরা এখন ঢাকার কল্যাণপুরে আছে।বিভোর আশেপাশেই কোথাও আছে।কাকে নাকি টাকা দেওয়ার ছিলো।দিয়েই আসবে।রাত নয়টায় ওরা মানিক এক্সপ্রেসে (ননএসি) বুড়িমারীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করবে।ভাড়া জনপ্রতি ৮৫০ টাকা
সায়ন বিভোরকে কল করে।বিভোর বললো, আসছে।সায়ন তিনজনের উদ্দেশ্যে বললো,
——“তোমরা গিয়ে সিটে বসো।আমি বিভোর একসাথেই আসছি।”
দিশারি রয়ে সয়ে বললো,
——“থাক!ও আসলেই উঠবো একসাথে।”
ঊর্মি,ধারা কথার মেলা নিয়ে বসেছে।বকবক করেই যাচ্ছে।এর মধ্যেই বিভোরকে দেখা যায়।সায়ন হাত তুলে আওয়াজ করে বিভোরকে বললো,
——“এইখানে….এইখানে।”
বিভোর দ্রুত পায়ে হেঁটে আসে।ধারা তাকায়।ব্ল্যাক জ্যাকেট পরা লম্বা ছেলেটাকে বড্ড চেনা মনে হচ্ছে তাঁর। যত এগুচ্ছে তত বেশি চেনা মনে হচ্ছে।আর মাত্র চার-পাঁচ হাত দূরে বিভোর তখন ধারা বিড়বিড় করে,
——“ও আল্লাহ!আমার বর!”
ধারা দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়।হৃদপিণ্ডের গতি বেড়েছে মারাত্মক।চোখ বন্ধ করে বিপদের সূরা বিড়বিড় করে পড়া শুরু করে,
——-“‘ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুমু বিরাহমাতিকা আসতাগিছ।”
আরবিতে বলার পর আবার বাংলায়ও উচ্চারণ করলো,
——-“হে চিরঞ্জীব! হে বিশ্ব চরাচরে ধারক! আমি তোমার রহমতের আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”
আবারো বিড়বিড় করে,
——“আল্লাহ বাঁচাও।পাব্লিকের সামনে মাইর খাওয়াইও না।”
বিভোর ধারাকে দেখিয়ে দিশারিকে বললো,
——“তোর বোন?”
দিশারি হু বললো।বিভোর রসিকতা করে বললো,
——“ভাবছিলাম তুই ই এতো লম্বা।এখন দেখি তোর চেয়েও লম্বা আছে।তো অন্য দিকে ফেইরা আছে কেন? শরম পাইতাছে নি?”
দিশারি ধারাকে ধরে ঘুরায়।ধারা এক চোখ বন্ধ রেখে তাকায় বিভোরের দিকে।বিভোর ভারি চমকালো।এক বছর আগের স্মৃতি মুহূর্তে চোখের পর্দায় ভেসে উঠলো।তবে,ধারা যে ধারাই পুরোপুরি শিওর হতে পারছেনা।সেদিন ধারার অনেক সাজগোজ ছিলো মুখে।আজকের মেয়েটা নরমাল।ঘোর লাগা গলায় জিজ্ঞাসা করলো,
——“নাম?”
ধারা কাঁপা গলায় বললো,
——“ধারা!সিদ্রাতুল ধারা।”
বড্ড চেনা কন্ঠ!বড্ড চেনা মানুষ!বড্ড চেনা নাম!একরাতেই এতো চেনা কেউ হয়?অথচ,তাঁর অবয়বই মনে ছিলোনা।তাহলে এই মুহূর্তে বিভোরের কেনো মনে হচ্ছে খুব চেনা?স্বামী-স্ত্রী নামক পবিত্র বন্ধনে আজও জড়িয়ে আছে বলে হয়তো!
বিভোরকে ওমন করে ধারার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দিশারি বিভোরকে ধাক্কা মেরে বললো,
——“কিরে? চিনিস নাকি?”
বিভোর ধারার দিকে তাকিয়েই জবাব দেয়,
——“হু।”
দিশারি সীমাহীন আশ্চর্য হয়ে বললো,
——“কেমনে?”
বিভোর কিছু বলার আগে ধারা উঠে বললো,
——“ফেসবুক ফ্রেন্ড!হ্যাঁ ফেসবুক ফ্রেন্ড।”
বিভোর স্তব্ধ হয়ে গেল।সেই সাথে আহত।পরক্ষণেই মনে হলো ধারার বয়ফ্রেন্ড আসার কথা ছিলো এক বছর পর।এসেছে?বিয়ে হয়েছে ওদের?মনের প্রশ্ন মনে রয়ে গেলো।মুখে কিছু বললো না।খুব স্বাভাবিকভাবে হেসে সায়নকে বললো,
——“মামা দাঁড়াই থাকবা?আয় জলদি।”
বিভোর বাসে উঠে সবার আগে।তারপর সায়ন,ঊর্মি।দিশারি ব্যাগ হাতে নিয়ে ধারাকে বললো,
—–“চল।”
ধারা বিব্রত হয়ে বললো,
—–“আপু আমি না যাই?”
দিশারি শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠে বললো,
——“সেকী!কেনো?”
ধারা আমতা-আমতা করে বললো,
—–“বাড়ি যাবো।
দিশারি সন্দিহান চোখে তাকায়।বললো,
—–“বিভোর কে দেখে যেতে চাচ্ছিস না কেনো?”
বিভোর ধারার বর।বলতে গিয়েও ধারা বলেনি।সে তো আর বিভোরকে ভালবাসেনা।দিশারি ভালবাসে।দিশারি যখন জানবে ছোট বোনের বর তাঁর ক্রাশ তাঁর ভালবাসা!হার্ট হবে খুব। যে সম্পর্কের মূল্য নেই দু’জনের কারোর কাছে সেই সম্পর্কের জন্য কাউকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবেনা।এসব ভেবে ধারা ঢোক গিলে।কথা সাজিয়ে বললো,
——“ফেসবুকে একটু তর্কতর্কি হইছিলো উনার সাথে।”
দিশারি হেসে বললো,
—–“দূর এসব কোনো ব্যপার হলো।দেখিস একদিনেই বন্ধুত্ব হয়ে যাবে।অনলাইন জগতে বিভোর খিটখিটে,কারো সাথে মিশতে পারেনা।কিন্তু বাস্তবে…..দেখতেই পাবি।চল।”
দিশারি ধারার হাতে ধরে টেনে বাসে উঠে।প্রথম সারিতে ঊর্মি,সায়ন,বিভোর আর বিভোরের পাশে একজন বয়স্ক লোক বসেছে।দ্বিতীয় সারিতে দিশারি আর ধারা।ধারাদের সিটের পাশের সামনেরটাই বিভোর।ধারার সিট থেকে স্পষ্ট এক পাশ দেখা যাচ্ছে বিভোরের।দুজনই গম্ভীর হয়ে বসে আছে।বাতাসে অস্বস্থি মিশে অক্সিজেন হয়ে নিঃশ্বাসে ভেতরে চলে যাচ্ছে।ধারা চোখা চোখে বিভোরের দিকে তাকায়।বিভোর সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে।
বাস ছাড়ে ঠিক রাত নয়টা পাঁচে।বাসে যে যার মতো ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়।অনেকে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।দুটি মানুষ শুধু দুজনের কথা ভাবছে।প্রেমের কথা নয়,ভালবাসার কথা নয়।দুজনই চাইছে বিপরীত মানুষটার থেকে আলাদা হতে।দুজনই দুজনের উপস্থিতি নিতে পারছেনা।কীভাবে পালানো যায়?পরবর্তী সময়গুলো একসাথে কেমনে কাটাবে? উত্তর নেই কোনোটার।
রাত গভীর।শীতের প্রকোপে অনেকে কাঁপছে।ধারার হাত,পা,মুখ ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে।বাসের সব জানালা বন্ধ করে দেওয়া হয়।ধারা ফোন বের করে ফেসবুকে লগ ইন করে।নিউজফিড স্ক্রল করতে থাকে।কিন্তু মন পাশের সারির সামনের সিটে।তাকাতে ইচ্ছে হচ্ছে একবার।ধারা তাকায়। দেখে, বিভোর এখনও চোখ বুজে আছে।
বিভোর অনেক্ষণ হলো ধারার কথা ভাবছে।মুখটা ভালো করে দেখা হয়নি।এখন তো সবাই ঘুমাচ্ছে একবার তাকালে কি হয়?বিভোর পিছন ঘুরে তাকায়।তখন ধারাও তাকিয়ে ছিলো।বিভোর-ধারা একসাথে কেঁপে উঠে।দুজনই চোখ সরিয়ে নেয়।ধারার হুট করে গরম লাগছে খুব।হাত পা মুখ কান গরম হয়ে এসেছে লজ্জায়।
বিভোর জোরে দম ফেলে।নিজেকে শাসায়,
——-“বিভোইরে আর তাকাবিনা ওই মেয়ের দিকে।আইন মোতাবেক বউ হলেই বউ বলেনা।এখন তোরা দুজনই অচেনা মানুষ।”
আচ্ছা কখনো কি ওদের পরিচয় ছিলো?একবার রাস্তায় দেখেছে ধারাকে।আরেকবার বাসর ঘরে।এইটুকুতে কেউ পরিচিত হয়? যদি হয়! তাহলে ওরা দুজনও পরিচিত।


সকাল আট টায় বুড়িমারী স্থলবন্দরে পৌঁছলো ওরা।পৌঁছেই নিজেদের পাসপোর্ট জমা দেয় মানিক এক্সপ্রেসের কর্মচারীদের কাছে।তাঁরা জনপ্রতি ২৫০ টাকা বিনিময়ে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনের সব কাজ সম্পন্ন করে দেয়।সায়ন বিভোরকে বললো,
—–“ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করি আগে।”
বিভোর সায় দিয়ে বললো,
—–“হুম চল।সামনেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে।”
ফ্রেশ হয়ে রেস্টুরেন্ট টেবিলে নাশতা করতে বসে ওরা।ধারা-বিভোর সরাসরি।বাকি তিনজন পকপক করে নাস্তা করছে।উল্লাস করছে। অথচ,এই দুজন চুপ।দিশারি ধারাকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
——“কিরে সারারাত পকপক কইরা ঘুমাইতে দেস নাই।আর এখন বিলাই সাজছোস!”
ধারা তরঙ্গহীন গলায় বললো,
——“ভালো লাগছেনা।”
——“এমা! ভ্রমণপ্রিয় নারী ভ্রমনে এসে বলছে,ভালো লাগছেনা অবিশ্বাস্য! “
বিভোর কান খাড়া করে সবটা শুনে।এমন করে চলতে থাকলে পাঁচটা দিন জলে যাবে।দুজনের বসে আলোচনা করা উচিৎ।যদি অস্বস্তি,আড়ষ্টতা কাটে!
সকাল ৯টায় ইমিগ্রেশন অফিস খোলার পর শুধু ছবি তোলার কাজটা লাইন ধরে সারতে হলো ওদের।ব্যস,বাংলাদেশ বর্ডারের কার্যক্রমের সমাপ্তি হলো।
এবার হেঁটে ভারতীয় ইমিগ্রেশনে ঢুকতে হবে।ঢুকার পথে বিভোর ধারার পাশ ঘেঁষে হাঁটে।ফিসফিসিয়ে বলে,
——“হোটেল বুকিংয়ের পর আমার সাথে দেখা করবেন।”
বলেই সে সামনে চলে যায়।ধারার ভ্রু দুটি বেঁকে গেলো। সাত-পাঁচ ভাবতে থাকে।কি জন্য দেখা করতে বলেছে? সব জেনে গেছে? নাকি মারবে?ধারা বিড়বিড় করে,
——“আল্লাহ এবারের মতো রক্ষা করো।প্রমিস করছি, আমি আর বাসা থেকে পালাবোনা।”
ধারার মনে হলো গায়েবি জবাব এসেছে,
——-“ধারা তুই এই নিয়ে কয়বার প্রমিস করেছিস?বার বার প্রমিস ভেঙ্গে পালিয়েছিস।এবার বরের হাতে মার খা…..
ধারা আবার বিড়বিড় করে,
——“না না।এইবার তিন প্রমিস।আমি আর পালাবোনা।”
দিশারি পাশে তাকিয়ে দেখে ধারা নেই।পিছনে তাকিয়ে দেখে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে।অনেক মানুষজন দেখছে।রাগ নিয়ে হেঁটে এসে ধারার মাথায় গাট্টা মেরে ধমক দেয়,
—–“বাল দাঁড়াইয়া ঘুমাস ক্যান?”
চলবে…….

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top