নবোঢ়া [পর্ব-৩৪]

জ্ঞান ফিরতেই জাওয়াদের চোখে পড়ল তার মুখের ওপর কয়েকটি অপরিচিত মুখ ঝুঁকে আছে। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। পিঠের হাড়গুলোতে তীব্র যন্ত্রণা, মাথাটা টনটন করছে।
চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারল, সে একটি হাসপাতালের কেবিনে। সাজসজ্জা আর আধুনিক যন্ত্রপাতি দেখে মনে হচ্ছে কোনো বড় প্রাইভেট হাসপাতাল। ঘরের কোণে গুলনূরকে দেখতে পেল। ভয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে, তার চোখেমুখে আতঙ্ক।
“গুলনূর!”
জাওয়াদের ডাকে চমকে তাকাল গুলনূর। তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
বিছানা থেকে নামতে যাচ্ছিল জাওয়াদ, এমন সময় উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন তরুণ এগিয়ে এসে বলল, “প্লিজ, এখনই নামবেন না। আপনার শরীর খুব দুর্বল।”
জাওয়াদের চোখে বিস্ময়। সে হতভম্ব কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “আপনারা কারা? আমি… আমরা এখানে কীভাবে এলাম?”
একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, “আমার নাম রাজ্জাক মজুমদার। আমরা তোমাকে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছি। সঙ্গে এই বোবা মেয়েটি ছিল।”
শরীরে তীব্র যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও জাওয়াদ বিছানা থেকে নেমে তাড়াতাড়ি গুলনূরের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি ঠিক আছো?”
গুলনূর মাথা নেড়ে সায় দিল। জাওয়াদ ঘাড় ঘুরিয়ে সামনের মানুষগুলোকে দেখল। পাঁচজননের মধ্যে একজন যুবতী, একটি পনেরো বছরের কিশোরী, একজন একুশ বছরের যুবক, একটি ছয় বছরের ছোট ছেলে, আর রাজ্জাক সাহেব, যার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে।
সে দ্রুত বলল, “আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু এখন আমাদের যেতে হবে।”
জাওয়াদ তাড়াহুড়ো করে বের হতে যাচ্ছিল, রাজ্জাক সাহেব বললেন, “কোথায় যাবে তোমরা? বলো, আমাদের গাড়িতে তোমাদের পৌঁছে দিই।”
“ধন্যবাদ। কোনো প্রয়োজন নেই।”
গতকাল রাতের ভয়াবহ মুহূর্তটি জাওয়াদ ভুলে যায়নি। যত দ্রুত সম্ভব এই অচেনা জায়গা থেকে পালাতে হবে। না জানি কোন বিপদ ওঁত পেতে আছে।
আর এই মানুষগুলোর অভিসন্ধিই বা কী, তাও জানে না! সে দেরি না করে গুলনূরকে নিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে বেরিয়ে গেল।
হাসপাতাল থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে দেখল, সাদা মার্বেলের মেঝে, দেয়ালে ফরাসি ধাঁচের প্যানেলিং, ছাদ থেকে ঝুলছে ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি। লবির একপাশে সাজানো হয়েছে অ্যান্টিক চেয়ার। যেগুলোর গায়ে সোনালি রঙের কারুকাজ।
দেয়ালে টাঙানো পুরনো রেডিও, টিভি। সবই তখনকার বিখ্যাত ব্র্যান্ডের। একপাশে জুকবক্সও আছে, যেখান থেকে ভেসে আসছে কিশোর কুমারের গান।
রিসেপশন ডেস্কে পুরনো টাইপরাইটার, দেয়াল ঘড়ি, এবং একটি ভিনটেজ ইন্টারকম। এমনকি হাসপাতালের লোগো এবং সাইনবোর্ডও তৈরি করা হয়েছে রেট্রো স্টাইলে। রাস্তা থেকে উদ্ধার করে অচেনা একটা ছেলেকে এতো বিলাসবহুল প্রাইভেট হাসপাতালে রেখেছিল কেন? জাওয়াদ বিস্ময়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল।
হাসপাতালের বাইরে এসে গুলনূরকে জিজ্ঞেস করল, “রাত থেকে কী কী হয়েছে বলোতো? কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম?”
গুলনূর তার হাত নেড়ে কিছু বোঝাতে চেষ্টা করল। জাওয়াদ ইশারা ভাষা বোঝে না। তাই সে গুলনূরের সঙ্গে খাতা-কলম দিয়ে যোগাযোগ করে, কিন্তু এখন তার কাছে সেই উপায়ও নেই। হতাশ হয়ে পকেটে হাত দিতেই চমকে উঠল! টাকাপয়সা তো দূরের কথা, তার পরনের জামাকাপড়ও বদলে গেছে!
বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ” আমার জামাকাপড় কীভাবে পরিবর্তন হলো?”
গুলনূর আবারও হাতের ইশারায় কিছু বোঝাতে চেষ্টা করল। জাওয়াদ অসহায়ভাবে বলল, “কিছুই তো বুঝতে পারছি না। কী বলতে চাইছ?”
সে চারপাশে তাকিয়ে দেখল, ব্যস্ত শহরের কোলাহল, মানুষের আনাগোনা, গাড়ির শব্দ। এই শহরে একপা নড়তেও টাকার প্রয়োজন। এখন একমাত্র ভরসা রাইহার ফুফাতো ভাই, তার প্রিয় বন্ধু। ওর কাছে পৌঁছাতেও তো পকেটে কিছু থাকা দরকার।
নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আরেক ধাক্কা খেল। তার প্রিয় হাতঘড়িটা নেই!
“আমার ঘড়ি কোথায়?”
গুলনূর তৎক্ষণাৎ নিজের বড় জামার হাতা গুটিয়ে দেখাল, ঘড়িটা তার হাতে আছে। সে ঘড়িটা খুলে জাওয়াদের হাতে তুলে দিল।
জাওয়াদ কিছুক্ষণ নির্নিমেষে তাকিয়ে রইল সোনার ঘড়িটির দিকে। চোখের তারায় ভেসে উঠল দাদিজানের মুখ। তার নিজের দাদি নয়, বাবার ফুফি। গত তিন-চার বছর ধরে কোনো যোগাযোগ নেই। বাড়ির সবাই তাকে সমীহ করে চলে, ধর্মপরায়ণতা আর কঠোর জীবনযাপনের জন্য। এই ঘড়িটা তারই দেওয়া, বিক্রি করতে মন সায় দিচ্ছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে তার কাছে আর কোনো বিকল্পও নেই। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুলনূরকে নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
গলিপথে ঢুকে একটা জুয়েলারি শপের সামনে থামল জাওয়াদ। দোকানের সাইনবোর্ডে লেখা ‘রহমান জুয়েলার্স’। পুরনো কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল সে। দোকানের মালিক বয়স্ক এক ভদ্রলোক।
পাতলা চশমার ফাঁক দিয়ে ঘড়িটা ভালো করে দেখে বললেন, “দাম ভালোই পাবেন।”
জাওয়াদের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল। দাদিজানের মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। কত আদর করে দিয়েছিলেন ঘড়িটা।
আড়তের দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে নাভেদকে দেখে শব্দর অবাক হয়ে গেল। ভ্রূ কুঁচকে তাকাল তার দিকে।
“বোসো শব্দর,” সুফিয়ান বললেন। তারপর একটু থেমে আবার বললেন, “আজ থেকে নাভেদ আমাদের সঙ্গে থাকবে।”
শব্দর বিস্ময় নিয়ে চেয়ারে বসল। সুফিয়ান প্রথম থেকে সব কিছু খুলে বললেন। কীভাবে নাভেদের সঙ্গে তার দেখা হলো, নাভেদ এখানে কী করে এলো, কেন তিনি তাকে বেছে নিলেন! নাভেদ ততক্ষণে তার পরিকল্পনা বলতে শুরু করেছে। প্রথমে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের কথা উঠল। যারা বড় পরিমাণে মাল কিনতে পারে না, কিন্তু নিয়মিত ক্রেতা হতে পারে। তারপর মহিলাদের হস্তশিল্পের কথা। যত বলতে লাগল, শব্দরের চোখে ক্রমশ বিস্ময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল।
“আপনি বলতে চাচ্ছেন, আমাদের আড়তে কোনো মাল থাকবে না?”
“না। সব বিক্রি হয়ে যাবে।” নাভেদ উৎসাহের সঙ্গে বলল, “আমি এখনই দেখিয়ে দিতে পারি।”
নাভেদ উঠে দাঁড়াল। তার চোখে মুখে আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক। “আমি আগামীকাল দুপুরের মধ্যেই ফিরে আসব।”
সুফিয়ান বাধা দিলেন, “নাভেদ, এখনই না। বাড়ি চলো, বিশ্রাম করো। আগামীকাল…”
“না হুজুর, আমার কাজই আমার বিশ্রাম। অনুমতি দিন।”
সুফিয়ান অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলেন। এমন একটা ছেলে তার হলো না কেন? এমন একজন বংশধর জমিদার পরিবারে কেন নেই? তিনি মাথা ঝাঁকালেন, “যাতে তোমার শান্তি।”
পরদিন সকালে নাভেদ ফিরে এল কয়েকজন ছোট ব্যবসায়ীকে নিয়ে। তারা আড়তের মাল দেখল, দাম নিয়ে আলোচনা করল। শব্দর লক্ষ্য করল, এদের প্রত্যেকেই ছোট পরিমাণে মাল চায়, কিন্তু সবার চাহিদা মিলিয়ে প্রায় অর্ধেক মাল বিক্রি হয়ে যাবে। এটা অভাবনীয়।
“এই তো শুরু,” নাভেদ আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলল, “আরও অনেকে আছে। আগামীকাল আসবে। আর মহিলাদের হস্তশিল্পের কাজ শুরু হলে তো নতুন বাজারই খুলে যাবে।”
শব্দর কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত সন্দিহান ছিল। এবার উঠে এসে নাভেদের কাঁধে হাত রাখল। কৃতজ্ঞতার সুরে বলল, “আপনি কী বিস্ময়কর মানুষ! ছোট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চুক্তি করার কথা আমার মাথায় এসেছিল। কিন্তু রাতারাতি এতোজনের সঙ্গে চুক্তি, তাও ন্যায্য মূল্যে! কীভাবে পারলেন?”
সুফিয়ান গর্বের হাসি হাসলেন। তিনি জানতেন নাভেদ পারবে। “এখন থেকে নাভেদ আমাদের সঙ্গেই থাকবে। আমাদের ব্যবসার আমির হয়ে।”
“হুজুর…” নাভেদ কৃতজ্ঞতায় বিগলিত হয়ে বলতে যাচ্ছিল।
নাভেদকে থামিয়ে দিলেন সুফিয়ান। বললেন, “হুজুর নয়, চাচাজান বলো।”
সন্ধ্যা নামার আগেই আড়তের অর্ধেক মাল বিক্রি হয়ে গেল। এক দিনের মধ্যেই নাভেদ প্রমাণ করে দিল যে সুফিয়ান সাহেব তার ওপর যে আস্থা রেখেছিলেন, তা অমূলক নয়।
পালঙ্কের উপর নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে জুলফা। মনের মধ্যে একটা আশঙ্কা ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাভেদ এসে পৌঁছাবে এই বাড়িতে। অতিথি ভবনে থাকবে। একই ছাদের নিচে থাকবে তার অতীতের মানুষটি আর বর্তমানের স্বামী। প্রেম? না, প্রেম তো হয়নি কখনো। তবু যে মানুষটি এতদিন ধরে মনের গভীরে গাঁথা আছে, সে কি প্রেমিক নয়? শুধু প্রেম করলেই কি কেউ প্রেমিক হয়? না কি মনের গভীরে থেকে যাওয়া মানুষটাই প্রকৃত প্রেমিক?
দিনগুলো কীভাবে পার করবে সে? চোখের সামনে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াবে নাভেদ। তখন কীভাবে মন দেবে স্বামীর প্রতি? সে তো সত্যিকারের একটা সংসার করতে চায়, পূর্ণতা দিতে চায় তার দাম্পত্য জীবনকে।
সকালবেলা বনে গিয়েছিল সে, সঙ্গে ছিল শব্দর। পাখিদের কলতানে মুখর ছিল চারপাশ। হঠাৎ একটা ছোট্ট পাখির বাচ্চাকে দেখতে দেখতে পেল। মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল। উপরে তাকিয়ে দেখল, গাছের ডালে বাসা। মা পাখি উদ্বিগ্ন হয়ে ডাকছিল। জুলফা যখন আলতো করে পাখির বাচ্চাটিকে তুলে নিল, ঠিক তখনই পেছন থেকে শব্দরের পদশব্দ শোনা গেল।
একটা লম্বা বাঁশের লাঠি হাতে নিয়ে এগিয়ে এল শব্দর। জুলফাকে বলল, “দাও, আমি ওকে বাসায় তুলে দিচ্ছি।”
লাঠির মাথায় একটা ছোট ঝুড়ি বেঁধে পাখির ছানাটিকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিল। মা পাখি আনন্দে ডানা ঝাপটাতে লাগল।
“আগেও কি এমন করেছেন?” জুলফার প্রশ্নে শব্দর মৃদু হেসে বলল, “ছোটবেলায় এই বনের সব পাখিদের দেখাশোনা করতাম। প্রায়ই ছানারা বাসা থেকে পড়ে যেত।”
জুলফা মুগ্ধ হয়ে তাকাল। শব্দর তখনো পাখির বাসার দিকে তাকিয়ে ছিল, তার চোখ থেকে ঝড়ে পড়ছিল মমতা।
জুলফা ভাবল, এমন একজন মানুষের সংসারে সে কতটা সুখী হতে পারে! যে একটা ছোট্ট পাখির জন্যও এত যত্ন নিতে পারে, সে নিশ্চয়ই তার স্ত্রীকে সারাজীবন ভালোবাসতে পারবে।
বর্তমানে ফিরে এল সে। নাভেদের কথা ভাবতে গিয়ে হঠাৎ করে মনে পড়ে গিয়েছিল ভোরের ঘটনা। পরমুহূর্তেই কানে বাজতে লাগল শব্দরের সেদিন রাতের কথাগুলো, “এই দীর্ঘ জীবনে একজন মানুষও জুটল না যে আমাকে বুঝবে, যার কাছে মনের সব কথা খুলে বলা যাবে। কেন… কেন এমন হলো জুলফা?”
কণ্ঠে কী অসহায়ত্ব! কী মায়া! জুলফা বুকের উপর হাত রাখল। শব্দরের প্রতি মায়াটা তার মধ্যে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। সে আলমারি খুলে বের করল শব্দরের ছোটবেলার কিছু ছবি।
প্রথম ছবিটিতে চৌদ্দ-পনেরো বছরের কিশোর শব্দর। পরনে সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি। গলায় জড়ানো রেশমি চাদর। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, তেলচকচকে। তার মধ্যে বাঙালি জমিদার বংশের সমস্ত সৌন্দর্য আছে।
আরেকটি ছবিতে শব্দর দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাগানবাড়ির বারান্দায়। পেছনে বিশাল থামগুলো। বারান্দার রেলিঙে লতানো মালতী ফুলের গাছ। শব্দরের পাশে একটি কাঠের আরাম কেদারা, তার উপর রাখা ইংরেজি উপন্যাসের বই। পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি, ধুতি। পায়ে পলিশ করা নাগরা জুতো।
সবচেয়ে সুন্দর ছবিটিতে শব্দর দাঁড়িয়ে আছে তাদের বাড়ির লাইব্রেরি রুমে। চারদিকে উঁচু উঁচু বইয়ের আলমারি। টেবিলের উপর খোলা বই, কাগজপত্র। দেয়ালে টাঙানো তৈলচিত্র। শব্দর বসে আছে চামড়ার আরাম কেদারায়, হাতে একটি বই। পরনে সিল্কের পাঞ্জাবি, ধুতি।
ছবিগুলো দেখতে দেখতে জুলফা ভাবল, শব্দর ওই বয়সে যদি তাকে বিয়ে করতে চাইত, নিশ্চয়ই রাজি হয়ে যেত। এখনো অবশ্য সুদর্শনই আছে, শুধু একটু পরিণত দেখায়। ছবিতে আলতো করে হাত বুলিয়ে ভাবল, “আমাদের ছেলে কী দেখতে এরকমই হবে?”
ভাবনাটা মনে আসতেই বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল। সে সন্তানের কথা ভাবছে! নিজের মনেই একটা মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে পড়ল ঠোঁটের কোণে। সঙ্গে সঙ্গে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল গালের পাশটা। পথেঘাটে বড় হওয়া মেয়ে সে, কিন্তু তার সন্তান হবে জমিদার বংশের উত্তরাধিকারী! মনের মধ্যে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। চোখের সামনে ভেসে উঠল একটা ছোট্ট শিশুর মুখ – যার চোখ-নাক-মুখ হুবহু শব্দরের মতো…
“মিটিমিটি হাসছ যে, কী এমন ঘটল?”
“ভাবছিলাম একটা ছে…”
কথাটা শেষ করতে গিয়ে থমকে গেল জুলফা। শব্দরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। লজ্জায় টকটকে লাল হয়ে উঠল মুখ। ঘাড় নিচু করে ছবিগুলো গুছোতে লাগল তাড়াতাড়ি। প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল! কী সর্বনাশ, সে প্রায় মনের কথাটা বলেই ফেলছিল!
শব্দর এগিয়ে এল একটু। তার চোখে উৎসুক দৃষ্টি। “কী বলছিলে? শেষ করো…”
জুলফার বুকের ভেতর টিপটিপ করছে। একটা অদ্ভুত, অলৌকিক অনুভূতি তাকে গ্রাস করে রেখেছে। কেন এমন হচ্ছে?
“আবার হাসছ।” শব্দরের গলায় মৃদু কৌতুক।
জুলফা তাড়াতাড়ি মুখটা গম্ভীর করল। “কোথায় হাসছি?”
“আমি দেখেছি। এই যে এখনও হাসছ। কী ভাবছিলে বলো, বলো…”
“কিছু না।” জুলফা মুখ ঘুরিয়ে নিল।
শব্দর জুলফার কোমর জড়িয়ে ধরল। তার কাঁধে থুতনি রেখে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কিছুতো ভাবছিলে।”
জুলফা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর আস্তে করে বলল, “ভাবছিলাম…”
“কী?”
জুলফার চোখে নামল লজ্জার ঘোমটা। কথাগুলো আটকে যাচ্ছিল গলায়, “যে, আমার ছেলে… মানে আমাদের ছেলে…দেখতে…মানে…ধ্যাত বলতে পারছি না। লজ্জা লাগছে।”
বলেই শব্দরের হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে দৌড়ে পালাল জুলফা। তার পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে থাকলেও শব্দর ঠিক সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে বিস্ময় মেশানো মুগ্ধতা, মুখে হাসি। বুকের গভীরে যেন অগণিত প্রজাপতি একসঙ্গে ডানা মেলেছে।
জুলফার বলা ভাঙা ভাঙা কথাগুলো মনের ভেতর বারবার ফিরে আসছে। মেয়েরা কেবল তখনই সন্তানের কথা ভাবে, যখন তার হৃদয় সন্তানের বাবাকে ভালোবেসে পূর্ণ হয়। এর মানে কি… জুলফা তাকে ভালোবাসে?
||
ঈদের দিন। আনন্দের জোয়ার বইছে পথে-ঘাটে। মানুষের কলরব, হাসি-খুশির শব্দ ছড়িয়ে পড়েছে আকাশ-বাতাসে। শুধু তৃতীয় তলার চিলেকোঠার ঘরটা অন্ধকারে ডুবে আছে। জানালায় কালো পর্দা। বাইরের আলো ঢোকেনি এখানে।
সে নিজের হাত নখ দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। দেয়ালে মাথা ঠুকছে বারবার। কপালে লাগা চোট থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। চোখের জল শুকিয়ে গেছে কখন।
মেঝেতে পড়ে আছে একটা ছবির ফ্রেম। কাঁচ ভেঙে গেছে। সে রক্তমাখা হাতে সেটা তুলে নিয়ে আবার ছুঁড়ে মারে দেয়ালে। কান্নায় ভেঙে পড়ে। বাইরের খুশির শব্দ ছাপিয়ে যায় তার কান্না।
দুপুরের রোদ এসে পড়ে জানালার ফাঁক দিয়ে। তবু ঘরটির অন্ধকার কাটে না। কাটবে না। কখনোই না।
চলবে…

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top