নবোঢ়া [পর্ব ৪৮]

নওয়াজের অন্তরের গোপন গলিঘুপচি থেকে বহুদিনের সঞ্চিত অনুভব ফেটে বেরিয়ে এলো৷ গুলনূরের মুখে হাত রেখে তার কপালের রেখা ছুঁয়ে বললেন, ‘তোকে খুব মনে পড়ছিল, মা।’

গুলনূরের চোখে মুহূর্তেই ছায়া সরে গিয়ে আলো এসে পড়ল৷ হয়তো নওয়াজ তার জৈবিক পিতা নন, কিন্তু তিনি তার জীবনদাতা… পিতার মতোই। যে ব্যক্তি মৃত্যুর অতল খাদ থেকে ফিরিয়ে আনে, চূর্ণবিচূর্ণ স্বপ্নের মাঝে নতুন কিরণরেখা ফোটায়, যে শিক্ষা দেয় যে প্রতিশোধ শুধু অনুভূতি নয় বরং কর্তব্যও, তাকে কি শুধু অভিভাবক বলে সীমাবদ্ধ রাখা যায়?

গুলনূর নিশ্চুপ। তার নীরবতা নওয়াজের চোখে সাড়া হয়ে পৌঁছাল। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে আবেগকে চেপে রাখার চেষ্টা করে বললেন, ‘চল এইবার। সময় চলে এসেছে।’

তার পঞ্চম…শেষ শিকার সিকান্দার মাতৃভূমি ত্যাগ করে পনেরো মাসেরও বেশি সময় যাবৎ বিদেশের কোন প্রান্তে আত্মগোপন করেছিল। এখন ফিরে এসেছে। সিকান্দারের ফিরে এলেই অরিজিত, নওয়াজ কান্তারপুরে এসে গুলনূরকে নিয়ে যাবে এমনই ছিল পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা। পরিশেষে আজ তারা এসেছে সিকান্দারের আগমনবার্তা নিয়ে। গুলনূর কতকাল অপেক্ষারত ছিল এই সংবাদটির জন্য!

তবুও গুলনূর বলল, ‘আমি এখনই যেতে পারব না৷’

অরিজিত এগিয়ে এসে বলল, ‘কেন? কী হয়েছে হঠাৎ?’

গুলনূর কিছুক্ষণ থেমে থেকে দূরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, ‘পরশু এসো। আমি জানাব, কবে যাব।’

শব্দ ফুরানোর সাথে সাথে সে ঘুরে দাঁড়াল। ছাতা খুলল, মুখ না ফেরিয়েই হাঁটতে লাগল। বিদায় জানাল না, একটাও ভদ্রতামূলক বাক্য উচ্চারণ করল না। অরিজিত তাকে থামানোর জন্য ডাকতে চাইলে, নওয়াজ তাকে আটকে দিলেন। বললেন, ‘ও যখন ‘না’ বলে, তখন তার মানে আছে।’

দেড় বছর আগের কথা। রাজধানী শহর তখন আধুনিকতার চাকচিক্যে মোড়ানো। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেই কুয়াশাচ্ছন্ন রহস্যময় আবহে ডুবে যেত চারপাশ। শহরের সংকীর্ণ গলিপথগুলোতে নিঃশব্দে হেঁটে বেড়াত রহস্যময় এক ঘাতক, যার পরিচয় জানত না কেউ। সবাই শুধু জানত, তিনটি লাশ একই কায়দায় খুন হয়েছে। প্রতিটি মৃত দেহের পাশে পাওয়া যেত ছোট চিরকুট। তাতে লেখা থাকত একটি শব্দ, ‘লজ্জা।’

লোকমুখে ঘাতকের নাম ছড়িয়ে পড়েছিল, ‘ছায়া খুনি’। অপরাধের সময় সে সর্বদা পুরুষ বেশে থাকত। পরনে দামি স্যুট-কোট, মাথায় হ্যাট। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৌড়াদৌড়ি করে কোনো সূত্র খুঁজে পাচ্ছিল না। সবচেয়ে বড় ধাঁধা ছিল খুনি পুরুষ নাকি নারী! লিঙ্গ নির্ণয় করা দুরূহ হয়ে উঠেছিল।

চতুর্থ হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল শহরতলির একটা ঘুটঘুটে রেলগেটের কাছে, একটা জীর্ণ দালানে। শিকার হয়েছিল আরিশ গাজী। মাদক সম্রাট ইলিয়াস গাজীর একমাত্র সন্তান। একমাত্র উত্তরাধিকারীর অকাল মৃত্যু ইলিয়াসের অন্তরে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল৷ তিনি উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন প্রতিশোধস্পৃহায়।

ঘটনাস্থলের একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন রেলগেটের বৃদ্ধ কুলি সবুজ মিয়া। মুহূর্তের জন্য হলেও তিনি দেখেছিলেন ঘাতকের চেহারা। স্যুট-কোট পরিহিতা এক নারী, যার তীক্ষ্ণ চাহনি, নির্ভীক ভাবভঙ্গি, আর কপালের ডানপাশে পাশে লম্বাটে ক্ষতচিহ্ন। সবুজ মিয়ার বিবরণ শুনে ইলিয়াস গাজী পুরনো হিসাবনিকাশের খাতা খুলে বসলেন, খোঁজ করতে লাগলেন ছেলের সমস্ত কদাচারের তালিকা। সেখান থেকেই উঠে এলো পিতৃ-মাতৃহীন অনাথ নয়নতারার গল্প।

অবিলম্বে ইলিয়াস তার পেট পুষা গুন্ডাদের ছুটিয়ে দিলেন দেশের কোণায় কোণায়। বাস, ট্রেন…নদীর ঘাট যেখানে সম্ভব সেখানেই নজরদারি বসানো হলো সেই মেয়েটাকে খুঁজে বের করার জন্য।

একদিকে পুলিশ অন্যদিকে ইলিয়াসের গুন্ডাবাহিনী, সিকান্দারও পালিয়েছিল বিদেশে অগত্যা নয়নতারা অর্থাৎ গুলনূর আত্মরক্ষার্থে আশ্রয় নিয়েছিল ভূঁইয়া পরিবারের অভ্রভেদী প্রাসাদোপম বাসভবনে। রেললাইনে আত্মবিসর্জনকারী এক দুর্ভাগা তরুণীর পরিচয় আত্মসাৎ করে সে অনুপ্রবেশ করেছিল সম্ভ্রান্ত ভূঁইয়াদের মহলে।

পরবর্তীকালে ঘটনাচক্রে জাওয়াদ তাকে নিয়ে পালিয়ে গেল রাজধানীতে। সেখানেই ইলিয়াসের চর তাকে চিহ্নিত করে ফেলল৷ ভীড়ের মাঝে বাজারে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হলো। দুর্ভাগ্যক্রমে অথবা গুলনূরের সৌভাগ্যক্রমে, তার বদলে আঘাত পেল জাওয়াদ।

সেই রাত্রিতেই ইলিয়াসের ভাড়াটে হত্যাকারীরা ঘিরে ফেলল তাদের আবাসস্থল। অসহনীয় তাড়নায় কোনোমতে প্রাণ বাঁচিয়ে পালাতে সক্ষম হলো দুজন। জাওয়াদ অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে জ্ঞান হারাল। বিকল্প উপায় না দেখে গুলনূর যোগাযোগ করল নওয়াজের সাথে। আহত জাওয়াদকে নিয়ে যাওয়া হলো বিলাসবহুল হাসপাতালে।

সুরঙ্গপথে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে গুলনূর একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ভূঁইয়া বাড়ির দিকে। এই প্রাসাদটি কেবল তার আত্মগোপনের আশ্রয়স্থল নয়, প্রতিশোধেরও উৎসস্থল। এখান থেকেই তার ভাগ্যের শুরু৷ তার এই দ্বৈত সত্তার মাঝে অপ্রত্যাশিতভাবে প্রবেশ করেছে জাওয়াদ। লোককথার রাজপুত্রের মতো নীলবর্ণ বাহনে চড়ে। কিন্তু সে তো কোনো রাজপুত্রের প্রত্যাশা করেনি! তবে কেন এসেছে জাওয়াদ? বলিদানের পশুর ন্যায় মৃত্যুবরণ করতে? যদি তার নিয়তি এই কলঙ্কিত জীবন হয়, তবে জাওয়াদের নিয়তি বলিদান! সে কোনো সহানুভূতি দেখাবে না।

কোহিনূরের অদম্য জেদের কাছে পরাভূত হয়ে না চাইতেও সুফিয়ান ভুঁইয়া জাওয়াদের সঙ্গে গুলনূরের বিয়েতে সম্মতি দিলেন। কিন্তু ললিতা বিধ্বস্ত জলাশয়ের মত উত্তাল। এই অসম বন্ধনের চিন্তাতেই তার অন্তরের বাতাসে বিষ মিশে যাচ্ছে। তিনি প্রথমে খোঁজ নিলেন জাওয়াদ বাড়িতে আছে কিনা। অনুপস্থিত শুনে তার মনের ভেতরের অগ্নিকুণ্ড আরও জ্বলে উঠল। ক্রোধে অন্ধ হয়ে গুলনূরের ঘরের দিকে তীরের মত ছুটে গেলেন।

গুলনূর নিজের ঘরে নীরবে কাপড় গোছাচ্ছিল। হঠাৎ দরজায় বজ্রপাতের শব্দ হলো। ললিতা প্রায় বাঁধ ভেঙে ছুটে আসা বন্যার মত দরজা খুললেন। বিচলিত হয়ে গুলনূর চোখ তুলে তাকাল।

ললিতা বিষাক্ত সাপের মত ফণা তুলে তেড়ে এলেন, ‘এ্যাঁই, তুই কী যাদুটোনা করেছিস আমার ছেলেকে? কেন ও তোর জন্য এমন উন্মাদ হয়ে উঠেছে? কোন মন্ত্রে বেঁধেছিস ওকে? কী করেছিলি শহরে?’

‘আমার সোনার সংসারে ছাই ফেলতে এসেছিস? আমার একমাত্র সন্তানকে, আমার জাওয়াদকে কেড়ে নিতে চাস? যাকে আমি আমার বুকের দুধ খাইয়ে লালন করেছি, যাকে আমি রাজপুত্র সাজিয়েছি, যার জন্য আমার প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাস উৎসর্গিত সেই আমার জাওয়াদকে তুই নিতে এসেছিস? সাহস কত তোর! তোর নোংরা হাতে আমার বংশের আভিজাত্য ধরে রাখতে পারবি ? তোর মধ্যে এমন কী আকর্ষণ লুকিয়ে আছে শুনি? এই রূপতো রাস্তার যে কোন মেয়েরই থাকে। আহামরি কিছু তো নয়…তবে কেন জাওয়াদ মাথা খুইয়ে বসল? কোন মন্ত্রের ফাঁদ পেতেছিস? কোন ওঝার সাহায্য নিয়েছিস?’

বলতে বলতে কাঁপছেন ললিতা। তিনি বলে যাচ্ছেন, ‘আমার ছেলে রেশমি চাদরে ঘুমিয়েছে, পাথরের মেঝেতে না। তোর নোংরা হাতে আমার সন্তানকে ছুঁবি কোন সাহসে?’

গুলনূর নত মাথায় নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল। তার নিস্পন্দ ভঙ্গিমা ললিতার আক্রোশকে আরও উস্কে দিল। তিনি প্রায় লাফিয়ে গুলনূরের বাহু শক্ত করে ধরলেন। গুলনূর ভীতিবিহ্বল হয়ে অসহায় শিশুর মতো সঙ্কুচিত হয়ে গেল।

‘জন্মহীন দাসী, কোন বংশের পরিচয় নেই তোর! এতদিন আমার ছায়াতলে থেকে, আমার অন্নে বেড়ে উঠে এই প্রতিদান দিতে চাস? আল্লাহ তোকে অণুমাত্র কৃতজ্ঞতাবোধ দেননি? তোর কী গণ্ডারের চামড়া? আমার কোনো কথা গায়ে লাগে না? তোর জন্মদাতারা কারা সেটাও জানি না আমরা! আমার জাওয়াদকে পদ্মপাতায় জল রেখে আমি মানুষ করেছি! যার জন্য সপ্তম আকাশের চাঁদ-তারাও নামিয়ে আনতে পারি! প্রতিটি রাতে যার জন্য আমি নামায পড়ে দোয়া করেছি! তার জন্য আমি যে মেয়েকে বউ হিসেবে কল্পনা করেছি, সে উজ্জ্বল শিক্ষার আলোয় আলোকিত হবে, সুশিক্ষিত কোন বংশের মেয়ে হবে…আর তুই? তোর অস্তিত্বই যে বর্জনের কালিমায় ঢাকা!’

ললিতার চোখ থেকে অশ্রু বের হতে লাগল। কিভাবে তার রাজকুমার তুল্য পুত্র এই সাধারণ প্রবাহে ভেসে যাবে? অহংকার, অভিমান, ও আতঙ্ক একত্রিত হয়ে তার হৃদয়ে দাবানলের সৃষ্টি করেছে।

হঠাৎ তিনি গুলনূরের বাহু থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে তার ঠোঁট চেপে ধরলেন, নখগুলো গুলনূরের কোমল ত্বকে বিঁধে গেল। বললেন, ‘এই ঠোঁট দিয়ে তো তুই কথা বলতেও পারিস না। কোন আত্মবিশ্বাসে নিজেকে আমার জাওয়াদের উপযুক্ত মনে করিস? আমার জাওয়াদ সোনালি রঙের জানালা দিয়ে সূর্য দেখেছে। শহরের সেরা স্কুলে পড়ে, ফরাসি শিক্ষকের কাছে পিয়ানো শিখে, ইংরেজি সাহিত্য পাঠ করে কেটেছে। আর তুই? তুই ময়লা কাপড় ধুয়েছিস, বাসন মেজেছিস, মেঝে নিকেছিস। তোর হাতে জমে আছে তেল-ময়লার দাগ। তুই কী করে আমার রাজহংসের যোগ্য হবি? তোর উপযুক্ত স্থান হলো সেবা করা, বিছানা গোছানো, বাসন ধোয়া। জমিদার পুত্রের হৃদয় দখল করা নয়!’

অতিরিক্ত চাপে গুলনূরের ঠোঁট থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ল।

ললিতা তাকে ছেড়ে ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘শোন, এখান থেকে দূরে পালা। আমি তোকে অনেক সোনাদানা দেব। অন্য কোথাও গিয়ে নতুন জীবন শুরু কর। আমার ছেলেকে তুই বিয়ে করিস না।’

গুলনূরের ভেতরটা রাগে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। এসব বাজে বুলির কি কোনো দাম আছে? এমন বিষঝরা মহিলা সে জীবনে দ্বিতীয়বার দেখেনি। মুখ দিয়ে শুধু বিষ ঝরে, আর সেই বিষও ঢালছে একেবারে অপাত্রে।

তার নীরবতা ললিতার ধৈর্যকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। তিনি হাতের পাঞ্জা দিয়ে গুলনূরের থুতনি এমনভাবে চেপে ধরলেন যেন সেটা মুঠোয় ভেঙে দেবেন। তার চোখে চোখ রেখে হিসহিস করে বললেন, ‘জাওয়াদ আবেগে ভাসছে। আমার অবুঝ ছেলেটা… কোনো কিছুই বোঝে না। তুই যদি এই বাড়িতে থাকিস, তাহলে একদিন না একদিন তোর গলা টিপে মেরে ফেলব। তার চেয়ে যা, দূরে চলে যা… আমি তোকে এমন ধন-সম্পদ দেব যা নিয়ে রাজার মেয়ের মতো জীবন কাটাতে পারবি। তোর কি আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? তুই…তুই দাঁড়া, আমি আসছি।’

উন্মত্ত প্রায় অবস্থায় ললিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। গুলনূর জড়োসড়ো অবস্থা থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁডিয়ে আঙুল দিয়ে ঠোঁটের তাজা রক্ত মুছে বিড়বিড় করল, ‘বিকারগ্রস্ত মহিলা।’

এবারই প্রথম নয়, বহুবার ললিতা তার গায়ে হাত তুলেছে। ভেবে রেখেছিল যাবার আগে ওই মহিলার অহঙ্কারী হাত ভেঙে দিয়ে যাবে। কিন্তু এখন তার প্রতিশোধের রূপ বদলেছে।

পায়ের শব্দে চমকে গুলনূর আবার আগের মতো সংকুচিত হয়ে গেল। ললিতা ফিরে এসেছেন, হাতে একটা ভারী বাক্স। তার ভেতরে জ্বলজ্বল করছে অগণিত সোনার গয়না।

‘নে,’ তিনি গুলনূরের দিকে বাক্সটা ঠেলে দিলেন, ‘এসব নিয়ে কোন দূর জায়গায় চলে যা। নতুন জীবন শুরু কর।’

গুলনূর বাক্সটার দিকে পাথরের মূর্তির মতো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর ললিতাকে হতবাক করে দিয়ে মিষ্টি হেসে কোলে তুলে নিল বাক্সটা।

  • ইলমা বেহরোজ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top