ছায়াতরু [পর্ব-২.৮] 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

স্মরণ, জিনিয়া, সিমানী, নয়ন আর তুষার নিঃশব্দে স্মরণের বাসায় এলো। বাসাটা আজ নিরিবিলি লাগছে বেশি। রাস্তায় নোমান সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিলো। লোকটা তাদের দেখতেই কোথা থেকে যেন দৌঁড়ে এসেছিলো। এসে স্মরণদের খুব রয়েসয়ে জিজ্ঞাসা করলো তখন,

“ কেমন আছো তোমরা ইয়াং লেডি এন্ড ম্যান? আজকাল বাসায় যাও না যে? নাকি আমার মতো বুড়োকে আর মনে পড়ে না?ʼ

লোকটা স্বভাবতই খুবই রসিক। সবকিছু রয়েসয়ে বলতে পছন্দ করেন এমন। জিনিয়া যখন আগবাড়িয়ে বললো,

“ আপনার বাড়ি তো আস্ত একটা মরণকূপ। ওখানে গেলে যদি আবার লাশ হয়ে ফিরে আসি সেটা তো হয় না।ʼ

নোমান সাহেবের মুখ দেখে স্পষ্ট বোঝা গেলো তিনি ভীষণ চমকেছেন। জিনিয়ার মুখের বুলি যেন নোমান সাহেবকে বড়ই আশ্চর্যান্বিত করেছে সাথে ভড়কেছে। তার বাসা মরণকূপ মানে কি? এদিকে জিনিয়ার এমন লাগামহীন কথাবার্তায় বাকিরা ভারী বিরক্ত। মুখে কুলুপ এঁটে থাকলে তো আর জাত যাবে না। এমনিতেও এই বাসার সব মানুষই খুবই ভয়ানক। কেউ হুট করে আসে আবার চলেও যায়। অদ্ভুতুরে এই বাসা যেন স্মরণের জীবন অর্ধেক জাহান্নাম বানিয়ে দিয়েছে। স্মরণ এই বাসা থেকে নিস্তার পেতে চাই।

নোমান সাহেবকে কোনোরকম বুঝিয়ে সবাই স্মরণের বাসায় এলো। স্মরণ দরজার তালা খুললো না। ভাবটা এমন যেন সে যদি দরজার তালা খুলে তবে বোম ব্লাস্ট হবে। এই সেই বোমা না আমেরিকার, হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে ফেলে দেওয়া সেই পারমাণবিক বোমা। স্মরণ সবার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন বাচ্চাটে স্বভাব!

ছোটবেলায় যেমন সবার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকলে পেছন থেকে ভুত এসে খাবে আর সামনে থাকলে সামনে থেকে এসে খাবে এমন ধারণা নিয়ে কিছু বাচ্চা থাকে, ঠিক তেমনই স্মরণের বর্তমান ভাবনা। ভয়ে চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে কিনা সন্দেহ!

রুমে ঢুকলো সবাই মিলে। রুমটা খুবই অগোছালো দেখা গেলো। স্মরণের দিকে তাকালো সবাই। স্মরণ ভ্রু কুঁচকে ঠান্ডা গলায় বললো,“ ওই বীথি নামক মেয়েটা সবকিছু এলোমেলো করে গিয়েছে। হয়তোবা টাকা খুঁজেছিলো।ʼ

“ কি এমন ঘুম দিয়েছিলি? যে একজন মানুষ তোর ঘর অগোছালো করছে অথচ তুই-ই জানিস না?ʼ

নয়নের কথায় রাগলো স্মরণ। দাত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,“ আমি কি ঘুমিয়েছিলাম নাকি? আমি তো অজ্ঞান ছিলাম সারারাত। ভাগ্য ভালো যে কেউ মেরে যায় নি আমাকে। নয়তো দরজা যেভাবে খোলা ছিলো সকালে, ওটা দেখে আমি নিজেই অর্ধেক মরে গেছি৷ ”

স্মরণের সন্দেহ হলো তার সাথে আবার কেউ খারাপ কিছু করে নি তো? এবার স্মরণের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হলো। মাথায় হাত দিলো সে। বজ্রাহত চোখে চাইলো জিনিয়ার পানে। জিনিয়া এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছিলো। হঠাৎ স্মরণের দিকে চোখ পড়তেই স্মরণের ওমন অবিশ্বাস্য চাহনী দেখে নিজেও ভড়কে গেলো। জিজ্ঞাসা করলো,“ কি হয়েছে? ”

স্মরণ তড়িৎ বেগে বললো,“ সুযোগ পেয়ে আমাকে আবার কেউ কিছু করে নি তো? হায়! আমার জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেলো রে। এ কোন বাসায় এসে পড়লাম আমি। এর থেকে তো ওই সৎ মায়ের বাসাই ভালো ছিলো। ”

সিমানী এগিয়ে এলো স্মরণের দিকে। স্মরণকে জিজ্ঞাসা করলো,“ রুম থেকে কি কিছু হারিয়েছিস? ”

“ রুম থেকে হারাই নি, নিজের থেকে হারিয়েছি। ”

খুবই আহত শোনালো স্মরণের কণ্ঠস্বর। নিমিষেই যেন ভেঙে পড়েছে মেয়েটা। তুষার এগিয়ে এসে বললো,“ ধুর, বাজে বকিস না। এমন কিছুই হয় নি। ”

নয়ন চোরাচোখে জানালার দিকে চাইলো একবার। দৃষ্টি সড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে স্মরণকে বললো,“ এমন কিছুই হবে না। কি ফালতু চিন্তাভাবনা তোর। কিছু হলে কি তুই বুঝতে পারতি না নাকি? ”

স্মরণ ফ্লোরেই বসে পড়েছিলো। এবার উঠে দাঁড়ালো। আসলেই তো! তার তো শরীরে এমন কিছুই অনুভুত হচ্ছে না। তবুও নারীমন। একটা ভয়ানক চিন্তাধারা মস্তিষ্কে উঁকিবুঁকি করবেই। নয়ন অন্যদিকে ফিরে বিড়বিড় করে বললো,

“ ছায়ার মতো কেউ একজন থাকতে এমন চিন্তাধারা বেমানান। ”

কেউ শুনলো না তার কথা। এরই মাঝে দরজায় কড়াঘাত পড়লো। লাফিয়ে উঠলো জিনিয়া, সিমানী আর তুষার। স্মরণ আর নয়ন স্বাভাবিক তখন। কেউ দরজা ধাক্কাছে, লাফিয়ে ওঠার মতো কিছু নয়। সিমানী কেমন ভয় নিয়ে বলে উঠলো,“ আমার এই বাসার কোনোকিছুই ঠিক মনে হচ্ছে না ভাই। স্মরণ তুই আমাদের বাড়িতে গিয়ে ওঠ। বাবাকে বললে বাবা না করবে না। ”

সিমানীর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ওয়েল। তার বাবা শামসে’র হক একজন সনামধন্য ব্যবসায়ী। বেশ নামডাক রয়েছে উনার। বন্ধুমহলের সিমানী আর নয়ন এই দুইজনের ফ্যামিলি ওয়েল রিনাউন্ড। বাকিরা মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। ছোট থেকেই একসাথে সবগুলো।

সিমানীর কথায় স্মরণ কিছু উত্তর করবে এর আগেই স্মরণের ফোনে কল এলো। আননোন নাম্বার দেখে ভাবলো ধরবে না। কল ধরলো না ঠিকই তবে পরপর দুবার কল এলো আবার। সবাই যখন বললো কল রিসিভ করতে স্মরণ কল রিসিভ করলে। লাউড স্পিকার অন করতেই অপরপ্রান্ত হতে ভেসে এলো কোনো মেয়ের কণ্ঠস্বর,

“ অনিল অসুস্থ। বাড়িতে এসে একবার দেখে যা। কখন মরে যায় ঠিক নেই। অনেক পাপ তো করলো। মরার সময় এসেছে। এবার দেখে যা। তোরও কবে এই দিন আসবে তারই অপেক্ষায়।ʼ

খুবই পরিচিত কণ্ঠস্বরে এমন বাজে সব কথাবার্তা সবার টনক নাড়িয়ে দিলো। কণ্ঠের মালিককে স্মরণ ঘৃণা করে। মেয়েটার মস্তিষ্কের বোধবুদ্ধি এতটাই লোপ পেয়েছে যে একজন মানুষকে নিয়ে এমন কটুক্তি করছে। স্মরণ খুবই শান্ত আওয়াজে জবাব দিলো,“ চিন্তা কোরো না। তোমার ভয়ানক পরিণতি না দেখে এতো তাড়াতাড়ি মরবো না।ʼ

ওপাশে থাকা রাহা বুঝি রেগে গেলো। কিন্তু স্মরণ কল কেটে দিলো। জিনিয়া স্মরণের কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলো,“ কে ছিলো? রাহা? ”

“ হু। ʼ

“ ছি! কি বাজে কথাবার্তা ওর। এতো খারাপ কোনো মেয়ে হয় জানা ছিলো না।ʼ

স্মরণের মুড কিছুটা নিম্নে নামলো। যত যাই হোক বাবা তো! রক্তের টান বলতেও তো কিছু একটা আছে নাকি? স্মরণ ভাবলো একবার দেখা করা উচিত। পুনরায় আবার নিজেকে দমিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। আবার ভাবলো সম্পূর্ণ খবরাদি সংগ্রহ করে বাবাকে দেখতে যাবে।

এদিকে দরজায় কেউ করাঘাত করেছে সেটা সবাই ভুলে গেছে। তবে এখন আর কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে না। সবকিছুই শান্ত। প্রসঙ্গ যে মুহুর্তের মাঝেই পালটে যায় তার চাক্ষুষ প্রমাণ যেন। নয়ন জিজ্ঞাসা করে উঠলো,“ কেউ না দরজায় টোকা দিয়েছিলো?ʼ

তুষার বললো,“ টোকা না, দরজায় ঘূর্ণিঝড় তুলেছিলো।ʼ

তুষারের দিকে বিরক্তিকর চোখে তাকালো নয়ন। তুষার অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। নয়ন গিয়ে দরজা খুলে দিলো, দেখলো কেউ নেই। চোখ পড়লো সামনে। স্মরণের রুমের সামনে বরাবরই তো বাহারাজ ভাইদের রুম। বাহারাজদের রুমের সামনে একটি সাদা কাগজ দেখে কপালে ভাঁজ পড়লো। এগিয়ে গেলো সেদিকে। কাগজটা হাতে তুলে নিলো। খুলতে যাবে এমন সময় কেউ একজন তাকে বাধা দিলো। নয়নেদ বাধাগ্রস্ত হস্ত তখনও কাগজ চেপে রাখায় শায়ন বললো,“ এটা পার্সোনাল। খুলিস না। ভেতরে যা। স্মরণকে যে করেই হোক বুঝিয়ে বল সবকিছু। আর সাবধান কিছুক্ষণ পরই বাসায় পুলিশ আসবে।ʼ

নয়ন অবাক হলো,“ পুলিশ কেন আসবে?ʼ

“ ফোনটা খুলে মেইল চেক দিস। বুঝে যাবি। এখন যা। ʼ

শায়ন সেই কাগজটা নিয়ে বাহারাজের রুমে ঢুকে পড়লো। নয়ন সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে স্মরণদের রুমে ঢুকলো। তবে মনের খচখচানি একটা রয়েই গেলো। দরজা কে ধাক্কা দিয়েছে?

_______________________

শায়ন ভেতরে এসে দেখলো রিয়াদ ফ্লোরে শুয়ে আছে। এই ঠান্ডার মাঝে ফ্লোরের শীতলতা যেন আরও দ্বিগুণ হয়ে যায়। এমন ঠান্ডার মাঝে রিয়াদকে শুয়ে থাকতে দেখে শায়ন ভারি বিরক্তি নিয়ে বললো,“ মরা মানুষের মতো শুয়ে আছিস কেন?ʼ

রিয়াদ প্রত্যুত্তর করলো না। সে অন্যকিছু ভাবছে। গতকাল থেকেই ভাবনাগুলো খুব বেসামাল লাগছে তার। জ্ঞানে সজ্ঞানে বারবার স্মরণ এসে ধরা দেয়। উঁকি মারে মনের কোঠায়। রিয়াদ নিজেকে সংযত করতে চাইলেও তো হয় না। যখনই ভাবে সে স্মরণকে ভুলে থাকার চেষ্টা করবে ঠিক তখনই স্মরণ এসে হানা দেবে সম্মুখে। এইতো আধঘণ্টা আগে স্মরণ আর ওর বন্ধুদের দেখলো খুবই ধীরসুস্থে নিঃশব্দে বাসায় আসছে। রিয়াদ শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

“ গতমাসে মেসেজ পাঠিয়েছি। কিন্তু এখনও কোনো রিপ্লাই আসে নি। আমরা কি সঠিক নাম্বারে মেসেজ পাঠিয়েছি? ”

শায়নের কথায় কেউ একজন ভেতর থেকে বসার রুমে আসতে আসতে বলে উঠলো,“ ভুল নাম্বারে মেসেজ দিলে রিপ্লাই আসারও কথা নয়। এমন গাধার মতো কাজ করলে চলে রে শায়ন?ʼ

শায়ন কপাল কুঁচকে তাকালো। বললো,“ নাম্বারটা তুই দিয়েছিলি!ʼ

থতমত খেয়ে গেলো ইফতি। হিরো সাজতে গিয়ে নিজেরই নাক কাটা যাচ্ছে তার।

চলবে,…

  • Junani CH

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top