পেখম? এই পলক? এই মেয়ে, তাকা আমার দিকে, কি হয়েছে তোর? কথা বল।”
জবাব এলো না! ভয়ে হাত পা কেঁপে উঠল সৌজন্যের। গলা শুকিয়ে আসছে সাথে। এলোমেলো মস্তিষ্ক নিয়ে পেখমের হাত ধরে পালস পরীক্ষা করে সৌজন্য। তারপর আবারো গালে হাত রেখে ভীত ও নরম গলায় বলল,
“এই পলক, তাকাও আমার দিকে। কি হয়েছে তোমার? কথা বলো? চোখ খুলে তাকাও, কি হয়েছে বলো আমায়…
এবারো কোনো জবাব এলো না। সৌজন্যের মাথায় চট করে কিছু একটা মনে হতেই দ্রুত সরে এসে কাবার্ড থেকে নিজের একটা শার্ট আর প্যান্ট পড়ে দ্রুত পেখমের জন্য জামা বের করে তাকে কোনো মতে তা দিয়ে আবৃত করে করে পেখমকে কোলো তুলে বেড়িয়ে যায় হসপিটালের উদ্দেশ্য। পেখম একদম নিস্তেজ হয়ে আছে। সৌজন্যের ভয় ঝেঁকে ধরে আছে। কোনো মতে বিল্ডিংয়ের নিচে নেমে পার্কিং লটে এলো। দ্রুত পেখমকে নিজের গাড়িতে তুলল। মেয়েটার এতো ব্লা-ড যাবার কারণ বুঝল না সৌজন্য।
হসপিটালে আসতেই ওয়ার্ড বয় স্টেচার এনে পেখমকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। যেহেতু ইন্টারনাল পাসেন্টা ব্লিডিং হচ্ছে। তা বুঝতে পেরে রিসিপশনের মেয়েটি একটু ভরকালো। কারণ এখন কোনো গাইনী ডক্টর হসপিটালে উপস্থিত হয়নি। সবাই আসবে সকাল নয়টার পর। আর এতোটা সময় অপেক্ষা করাও সম্ভব না। এমনিতেই খুব সিরিয়াস কেস মনে হচ্ছে। আগে ব্লিডিং বন্ধ করা লাগবে তারপর নাহয় বাকিটা দেখা যাবে। রিসিপশনের মেয়েটা নিজেও চিন্তিত, এদিকে সৌজন্যেরও ভীত হয়ে সব শুনে শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। রিসিপশনের মেয়েটা আগে একজন গাইনী ডক্টরে কল দিয়ে তাকে জানায়। এখন হসপিটালে তিনটা ডক্টর উপস্থিত। একজন অন্য অপারেশন থিয়েটারে, আরেকজনের সকাল ছয়টায় ডিউটি শেষ তাই সে ঘুমাচ্ছে। আরেকজন আছে, তাকে ডাকবে কিনা তা ভেবে মেয়েটা একটু তটস্থ হলো। কারণ ওই ডক্টর, এই হসপিটালের ইনভাইটেড প্রফেসর ও কনসালটেন্ট। কিন্তু তাকে ইনফর্ম না করলেও মেয়েটার সত্যি যদি কিছু হয়ে যায়। তাই রিসিপশনের মেয়েটা খুব জড়তা নিয়ে নম্বর ডায়াল করতেই ক্ষানিকবাদে বিপরীতে থাকা কল রিসিভ হয়। মেয়েটা একটু সংবিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল,
“হ্যালো, ডক্টর. আশরিয়াল নওশির?”
“ইয়েস, অন ডিউটি!”
নির্বিকার স্বভাবে জবাব করে নওশির। মেয়েটা নওশিরের শীতল প্রতিত্তোরে একটু চিন্তামুক্ত ও শান্ত হলো। তারপর সৌজন্যের দিকে তাকিয়ে গলা পরিষ্কার করে ফের নওশিরের উদ্দেশ্যে বলল,
“ডক্টর, দেয়ার’স এন ইমার্জেন্সি। লেট মি ব্রিফ ইউ। এ্য নিউ পেশেন্ট জাস্ট এরাইভড। সি ইজ ব্লিডিং এন্ড আই সাপোজ ইটস ইন্টারনাল। আ’ম নট শিউর, বাট ইফ ইটস নট স্টপড ইন টাইম, সি উইল প্রোবাবলি ডাই। ফর দ্য রেকর্ড, দেয়ার’স নো গায়নাই রাইট নাউ। সো, আই হ্যড টু কল ইউ ফর দিস ইমার্জেন্সি। কুড ইউ প্লিজ চেক অন হার রিয়েল কুইক?
নওশির মনোযোগ সহকারে পুরো কথা শোনার পর একটু থমকাল। তারপর দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে নিজের হাতের মোটা ডায়ালের ঘড়িতে সময় দেখল। সাতটার এপারওপার। এই সময় এমন কেস? একটা লম্বা শ্বাস ফেলল, বুঝতে সময় লাগেনি কি হয়েছে। ঠোঁট বাকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসল তারপর শীতল ও নির্জীব গলায় শুধায় বলল,
“ওকে। আ’ম অন মাই ওয়ে।!”
নওশির রিসিপশনের সামনে এসে একবার সৌজন্যের দিকে তাকাল। সৌজন্যের মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে চিন্তিত সাথে সেই যে পেসেন্টের বাড়ির লোক তা বুঝতে পারল নওশির। ইন্টার্নাল ব্লিডিং কেস কেন বুঝতে পেরেছে তাই চোখের দৃষ্টি আরো সীঁথিল করে সৌজন্যেকে দেখল, চোখে মুখে ভীত আভা। মেয়েটার জন্য হলে আরো গাঢ় হত, তবে তার ভীতু মুখ অন্যকিছুর ঈশারা করছে। সৌজন্যের শরীরের শার্টের র-ক্ত শুঁকিয়ে এখন তা বিদঘুটে দেখাচ্ছে। চোখ সরিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকল নওশির।
নওশির যেতেই একবার মাথা তুলে সৌজন্য ঢোক গিলল তারপর পাশের সীটে ধুপুস করে বসে মাথায় হাত দিয়ে নিজের চুল টেনে ধরল। এর আগেও পেখম সৌজন্যেকে সব ভাবেই সামলেছে। মেয়েটা শক্ত প্রকৃতির তবে কি এমন হল যে সে এমন হলো। পেখম যে সৌজন্যর সাথে আনিয়ার ছবি আর মেসেজ দেখেছে তা বুঝতে বাকি নেই তার। কিন্তু সমস্যা এটাই পেখম ওর বাবার বাড়ি যাওয়া মানে সৌজন্যের মা, খালা থেকে শুরু করে সবাই যেনে যাবে এসব৷ ব্যাপারটা ভালো দেখায় না। আরেকদিকে পেখম ঠিক বলেছে। আনিয়া পেখমের থেকে সুন্দর, ম্যাচিউর, শিক্ষিত। কিন্তু! কিন্তু আনিয়ার থেকে পেখম একটিভ। একমাত্র এই মেয়েটার কাছেই সৌজন্য নিজের শান্তি খুঁজে পেয়েছে। মেয়েটা খুব আদুরে আবহে তাকে জড়িয়ে নেয়। একটু টু শব্দ করে না। এইটা ছাড়া এই মেয়ের মাঝে আছে কি? না আছে পড়ালেখা আর না আছে কোনো চালচলন-বলন। আবারো নিজের ভাবনা ভাঙ্গল। মেয়েটা তার জন্য এই অবস্থা, কিছু হলে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। ঢোক গিলল। এর মধ্যে পকেটের ফোনটা বিপবিপ করে কেঁপে উঠল। সাথে সৌজন্যেও একটু থমকে পকেট থেকে ফোন বের করে, আনিয়া মেসেজ দিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা বন্ধ করে দিল। এই মেয়েকে কতবার বলেছে বাসায় থাকলে কল বা মেসেজ দিতে না। আর মেয়েটা যেন বাড়ন না মেনে আরো বেশি জ্বালাতন করছে। এই মেয়ের কাণ্ডজ্ঞানহীনতার কারণেই তো আজকে পেখমর হাতে সে ধরা পড়েছে নাহলে ধরা পড়ার কোনো পথ আছে নাকি?
খানিকবাদে অপারেশন থিয়েটার থেকে নওশির বের হয়ে আগে রিসিপশনিস্ট মেয়ের কাছে যায় তারপর গম্ভীর কণ্ঠে তাকে বলল,
“কনট্যাক্ট দ্য সিডিউল্ড গাইনী ডক্টর। কুইক! এন্ড আস্ক হার টু হারি টু দ্য হসপিটাল এ্যাজ শুন এ্যাজ পসিবল। হার কনডিশন ইজ ভ্যারি ক্রিটিকাল।”
নওশিরের কথা সৌজন্য স্পষ্ট শুনতে পেল। সাথে একটু চমকাল। তাই সীট ছেড়ে উঠে এসে নওশিরকে উদ্দ্যেশ করে শুধায়,
“এক্সকিউজ মি, ডক্টর?”
ফিরে তাকালো নওশির তারপর সৌজন্যকে পরক্ষ করে ধীরে চোখের পলক ফেলে বলল,
“ইয়েস?”
“পেখম? আই মিন হোয়াট ইজ হার কন্ডিশন?”
শীতল চোখে সৌজন্যের চিন্তিত মুখটা পর্যন্ত করে নির্বিকার গলায় শুধায়,
“সী’জ স্টিল ইন ডেঞ্জার এন্ড অলসো সী ওয়াজ নাইন উইক’স প্রেগন্যান্ট বাট…
থমকায়, চমকায়, ভরকায় সৌজন্য। প্রেগন্যান্ট? কই পেখম তো তাকে কিছু বলে নি! তাহলে? এই ব্লি°ডিং? ঢোক গিলল তারপর ভীত গলায় শুধায়,
“প্লিজ ডোন্ট সে, দ্য বেবি ইজ নো মোর!”
“বাট অনফরচুনেটলি ইয়েস! দ্য বেবি ইজ নো মোর!”
কথাটা বলে নওশির চলে গেল। সৌজন্যের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। হাত পা কাঁপন উঠে গেল সাথে। কি থেকে কি হলো কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না। নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে সে কি করে ফেলেছে? তার অংশ সে নিজেই নষ্ট করেছে। আর পেখম? পেখম বাঁচবে তো? মাথা ধরে এলো। কাঁপা হাতে ফোন বের করে কোনো মতে সৌজন্যের মাকে কল দিয়ে বলল,
“বেশি কথা বলার সময় নেই মা। দ্রুত হসপিটালে আসো।”
অবাক হয় সৌজন্যের মা। এতো সকালে ছেলের কল তারপরে হসপিটালে যেতে বলছে? চিন্তিত গলায় শুধায়,
“কেন বাপ? কি হয়েছে? তুই ঠিক আছিস?”
ঠোঁট চেপে নিজেকে অনেক কষ্ট আটকে নেয় সৌজন্য তারপর ফের বলল,
“সকালে পেখম পা পিছলে ওয়াশরুমে পড়ে গেছে। দ্রুত এসো।”
কথাটা বলে কল বিচ্ছিন্ন করতেই সাদা এপ্রন পড়িহিত এক মহিলা দৌড়ে এসে রিসিপশনিস্ট মেয়েকে বলল,
“কি অবস্থা মিতু, দ্রুত সার্জিক্যাল এপ্রোন আর মাস্ক দেও। আর মেয়েটার আপডেট কি, বলো?”
মিতু নামের মেয়েটা ঢোক গিলল, তারপর কোনা চোখে একবার স্তব্ধ সৌজন্যকে দেখে ডক্টরের দিকে তাকালো তারপর বলল,
“নওশির স্যার কোনো মতে ব্লি-ডিং বন্ধ করেছে। মেয়েটা নয় সপ্তাহের বেশি প্রেগন্যান্ট ছিলো বাট মিসক্যারেজ হলো। মেয়েটার বয়সও তেমন নয় ম্যাম! মাত্র ২২ বছর বয়স। তাও রিসেন্ট!”
ডক্টর শিউলি মাথা নাড়িয়ে হতাশ শ্বাস ফেলল তারপর বলল,
“রেয়ার কেস। বাঁচার সম্ভবনা খুব কম। আর বেঁচে গেলেও আর বেবি হবে কিনা সন্দেহ। সাথে ট্রমাটাইজ হবে ভালোই! পোস্ট মিসক্যারেজ এবনরমালিটি উইল হিট হার।”
মিতু জবাব দিল না। সৌজন্য সব শুনছে সাথে প্রতিটা কথার সাথে সাথে যেন তার শরীরে সুঁ-ই ফুটছে। ডক্টর শিউলি আবারো মিতুর দিকে তাকায় তারপর কপাল কুঁচকায় আর জিজ্ঞেস করল,
“নওশির কে? ওই বিদেশী ডক্টর? যে আমাদের মেডিক্যাল কলেজের ইনভাইটেড প্রফেসর?”
“জ্বি ম্যাডাম!”
একটু আস্বস্ত হলো ডক্টর শিউলি। লোকটা নিজের কাজের প্রতি যথেষ্ট সিনসিয়ার। কথা শেষ করার পর অপারেশন থিয়েটারের দিকে যাবার আগে সৌজন্যের দিকে দৃষ্টি আটকায়। তা দেখে মিতুর দিকে তাকাতেই মিতু নিচু গলায় বলল,
“মেয়েটার হাসবেন্ড।”
ঠোঁট কোন বাঁকা করল। তারপর বলল,
“কি বলেছে? মেয়েটার এমন কিভাবে হয়েছে?”
মিতু সহজ গলায় বলল,
“ওয়াশরুমে স্লিপ করে পড়ে গেছে।”
ডক্টর শিউলি চোখ সরিয়ে নিয়ে সৌজন্যের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় শুধায়,
“ফ্রডটা মিথ্যা বলেছে।”
চলবে…
- প্রানেশা আহসান শীতল