সেদিন ও সে [পর্ব-০৩]

সৌজন্যের মা এসেছে একটু আগে। সাথে তার খালাও। পেখমের মা হসপিটালের করিডোর থেকে দৌড়ে ঢুকলও কেবল। এসেই সৌজন্যের হাত ধরে বলল,

“আমার মেয়ে কই বাবা? কিভাবে হল? তুমি কি খেয়াল রাখো নি?”

জবাব দিল না সৌজন্য। নীরব রইল। পেখমের মা শব্দের ঝংকার তুলে কান্না করছে। একমাত্র মেয়ে তার। অতি আদরে বড় করেছে, বান্ধবীর কথা না ফেলতে পেরে নিজের কলিজা এনাদের হাতে তুলে দিয়েছে সেখানে এত্ত বড় শকিং নিউজ যেন হজম হচ্ছে না পেখমের মা পল্লবী বেগমের। খানিকবাদেই অপারেশন থিয়েটার থেকে নওশির বেড়িয়ে গেল। যাওয়ার সময় আরো একবার সৌজন্যের দিকে শীতল চাহনী নিক্ষেপ করে, তবে চলে যাবার আগে পল্লবী বেগমকে দেখে থমকাল। ছাইরংয়ের চোখটা ছোট ছোট হলো, পল্লবী বেগমও চোখ মুছে সামনে তাকাতেই নওশিরকে দেখে থমকায়। অবাক চোখে তাকায়, নওশির কিছু না বলে আবারো নিজের কেবিনের দিকে চলে যায়। পল্লবী বেগম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, আবারো খানিকসময়ের অপেক্ষা… তারপর অপারেশন থিয়েটার থেকে বেড়িয়ে এলো ডক্টর শিউলি, তাকে দেখে সৌজন্য একটু নড়েচড়ে বসল, পল্লবী বেগম আগে যেয়ে জিজ্ঞেস করল,

“আমার মেয়ে, আমার মেয়ের কি অবস্থা ডক্টর?”

ডক্টর শিউলী শান্ত ও নির্বিকার চোখে তাকায় পল্লবী বেগমের দিকে তারপর নিজের আন্দাজ করে জিজ্ঞেস করল,

“আমি যদি ভুল না হই, আপনি মেবি আমাদের মেডিক্যাল স্টুডেন্ট পলকের মা আই মিন পেসেন্টের মা? আ’ম আই রাইট?”

পল্লবী বেগম একটু চমকায় তারপর মাথা নাড়িয়ে বলল,

“জ্বি!”

ডক্টর শিউলি চোখে হাসলেন। তারপর বলল,

“পলকের এই অবস্থা দেখে আমি ভরকেছি। আপনাকে দিয়ে এমনটা আশা করিনি। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগপর্যন্ত আমি ভেবেছি নরমাল কোনো প্রেসেন্ট হবে, কিন্তু ভেতরে ঢুকে পলককে দেখে অবাক হলাম। ও আমাদের মেডিক্যাল কলেজের ব্রাইড স্টুডেন্ট ছিল। তার সিনসিয়ারিটি দেখে আমরা ধারনা করেছিলাম এই মেয়ে পড়াশোনায় টপ থাকবে। সেখানে এক টার্ম কমপ্লিট করে হারিয়ে গেলো মেয়েটা। তারপর একবছরের বেশি সময় পর দেখা হলো তাও এই অবস্থা! কখনো ভাবি নি, নিজের স্টুডেন্টের অপারেশন নিজের হাতে করা লাগবে।”

সৌজন্য একটু ভরকায়। এরিয়ার বড় প্রাইভেট মেডিক্যালে নিয়ে এসেছিলো সে, অথচ তার মাথা থেকেই বের হয়ে গেছিল একদা পেখম নিজেও মেডিক্যাল কলেজের স্টুডেন্ট ছিল। আর এটাই সেই মেডিক্যাল। মহিলা কি কোনো ভাবে পেখমকে চেনে? হ্যাঁ, চেনে নাহলে এত স্বাভাবিক ভাবে কথা কি করে বলছে তাও তার অন্যনাম ধরে?

ডক্টর শিউলি নিজের কথা শেষ করে তীক্ষ্ণ নজর ফেলল সৌজন্যের দিকে। তারপর পল্লবী বেগমের দিকে তাকিয়ে ফের জিজ্ঞেস করল,

“পলকের হাসবেন্ড?”

পল্লবী বেগম মাথা ঘুরিয়ে তাকায় সৌজন্যের দিকে। ততক্ষণে সৌজন্যের মা ও খালা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তাদের মাঝে। পল্লবী বেগম মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। ডক্টর শিউলি হতাশ শ্বাস ফেলল তারপর বলল,

“আমি যা বলব শক্ত ভাবে বলব, আপনারা একটু শক্ত থাকবেন?”

পল্লবী বেগম একটু ভীতু হয়। তারপর আবারো সায় জানায়। সৌজন্যের মা ও খালা একে-ওপরের দিকে তাকিয়ে আবারো সৌজন্যের দিকে তাকায়। সৌজন্য বোধহয় জায়গা থেকে নড়তে পাড়ছে না। তার পা মেঝেতে আঁটকে গিয়েছে। ডক্টর শিউলি শ্বাস ফেলল। তারপর ধীর চোখে আরো একবার সৌজন্যকে দেখে নিয়ে নরম ও সহজ গলায় বলল,

“পলক ওয়াজ নাইন উইক অর সামথিং প্রেগন্যান্ট। আমি ধারণা করছি তার টুইন ফিটাস এসেছিলো। বাট আনফরচুনেটলি সী হ্যড মিসক্যারেজ! আরো একটা কথা, সে কোনো ওয়াশরুমে স্লীপ খায় নি। তার শরীর দেখে অন্তত আমার তা মনে হয় নি। আপনারা পেসেন্টের মা এবং মায়ের বয়সী তাই আর মুখে বললাম না কিছু। তবে দেখে মনে হয়েছে সামথিং ইলস। হার হাসবেন্ড ডিড সামথিং ইন্টিমেট। এন্ড….মাস্ট বি রাফ অন পারপাস। আমি ঠিক কি বলতে চাচ্ছি, তা আপনি বুঝতে পারছেন আশা করি?”

এতোটুকু বলে থামল ডক্টর শিউলি তারপর সৌজন্যর দিকে তাকাল। সৌজন্য মেঝেতে তাকিয়ে আছে মাথা নিচু করে। সৌজন্যর মা ও খালা হতচকিত, পেখমের মা চিৎকার করে কান্না করবে নাকি কি করবে যেন মাথায় আসছে না। ডক্টর শিউলি সৌজন্যর দিকে তাকিয়েই ফের মুখ ঘুরিয়ে স্বভাবসুলভ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“পলক এখনো ডেঞ্জারাস জোন থেকে বের হয় নি। দোয়া রাখবেন ওর জন্য! ওকে অবজারভেশনে রাখার পর কন্ডিশন স্টেবল হলে কেবিনে সিফট করা হবে। এতো ব্যাড নিউজের মাঝে একটাই সুখবর হলো, আমি ভেবেছিলাম সে তার মাতৃত্বের ক্ষমতা হারাবে। তবে এখান থেকে পলক একটু সার্ভাইব করে গেছে, সে বেবির কথা চিন্তা করলেও পাঁচ থেকে ছ-বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ তার এই বয়সের এই ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠতে তার সময় লাগবে। আর হ্যাঁ, এর কারণে যে ট্রমাটাইজ হয়েছে তার জন্য নিয়মিত সাইকোলজিস্টের ও ডক্টরের পরামর্শ ও ট্রিটমেন্টে রাখবেন। তাহলে হয়ত দ্রুত রিকভারি করবে সে। হয়ত ভাবতে পারেন আমি কেন এসব বলছি, প্রথমত আমি একজন ডক্টর। তাছাড়া পলককে আমি একজন টপ স্টুডেন্টদের মাঝেই চিনতাম। সাথে পলকের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো। তবে প্রথম টার্ম শেষ করে মেয়েটার সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারিনি। তাই আমি চাই না মেয়েটা এতোটা পেইন নিয়ে নিজের অর্ধেক জীবন কাটাক। তাই এতোটা পরামর্শ, তবে আপতত আল্লাহর কাছে দোয়া করুন; ২৪ ঘন্টার আগে আমরা কোনো কিছুই বলতে পারছি না, না কোনো নিশ্চয়তা যে সে আদোও জ্ঞান ফিরে পাবে কিনা। সব ধরনের নিউজের জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখুন!”

কথাগুলো বলেই চলে যাবার জন্য পা এগিয়েও আবার থমকে গিয়ে পল্লবী বেগমের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলল,

“রং পার্সন – রং টাইম!”

কথা টুকু বলেই চলে গেলো ডক্টর শিউলি। যেন প্রতিক্রিয়া করার সময় দিল না পল্লবীকে। সৌজন্যর মাও প্রতিক্রিয়া দিতে ভুলে গেলো। সৌজন্যের খালা এগিয়ে এসে সৌজন্যের পাশে বসে শক্ত গলায় শুধায়,

“পেখমের সাথে কি করেছিস সৌজন্য?”

জবাব দিতে পারল না সে। খালা আবারো জিজ্ঞেস করল,

“তুই তো বললি ও স্লীপ খেয়েছে তাহলে ডক্টর অন্যকিছু বলল কেন? কি লুকচ্ছিস? কি হয়েছে তোদের মাঝে?”

সৌজন্য ঢোক গিলল তারপর সাফাই গাওয়ার গলায় বলল,

“খালামনি আমি, …

এতো কথা শুনতে চাইল না তার খালা। তার আগেই শক্ত গলায় বলল,

“কি হয়েছে সেটা বলবি, কোনো বাড়তি কিছু নয়! আমি পেখমকে ঠিক কতটা আদর করি তা কারো অজানা নয়; তোকেও আদর করি। তাই আমি সুক্ষ্ম ভাবে সব শুনে তারপর তোদের বিচার করব! আর বাকি সিদ্ধান্ত নেব।”

সৌজন্য আবারো অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকালো। তারপর আবারো খালার দিকে তাকিয়ে খপ করে তার হাত ধরে ভীতু ও কাঁপা গলায় বলল,

“খালা আমি খুব বড় ভুল করে ফেলেছি। অনেক বড় ভুল!”

শীতল চোখে চাইল সৌজন্যের খালা। সৌজন্য আবারো মাথা নিচু করে বলল,

“আমি, আমি পেখমকে রেখে ভার্সিটির যেই মেয়েকে পছন্দ করতাম সেই মেয়ের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়েছি। তার সাথে আমার শারীরিক সম্পর্কও আছে। সে এখন আমার অফিসের কলিগ! আর সেটা পেখম টের পেতেই আমি একটু ঘাবড়াই। তাই ও যখন বাসায় ওর যাবার কথা বলল, আমি ভরকে গেছিলাম এই ভেবে তোমরা সবাই আমার ব্যাপারে যেনে যাবে। তার উপরে ও বারবার ডিভোর্সের কথা বলছিল। তাই আমি নিজের রাগ ও জেদ কাবু করতে না পেরে এসব করেছি। কিন্তু এমন কিছু হবে তা ভাবিনি। এমন দেখে অনেক ভয় পেয়েছি। তাই হসপিটালে নিয়ে এসে এসব জানতে পারি। আমার খুব অসহায় লাগছে খালা। আমি ওকে ভালোবাসি খালা, আমি ভুল করেছি।”

সৌজন্যর খালা শীতল চোখে তাকিয়ে ফের বলল,

“তোমার মুখে অন্তত এসব মানায় না সৌজন্য।”

একটু লজ্জা পেলো সৌজন্য তারপর বলল,

“আমি জানতাম না ও তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। ও আমায় বলেইনি!”

“তুমি জানতে চেয়েছো?”

“না!”

“তাহলে যাকে আদর – যত্নে আগলে রাখতে পারো নি সেখানে কিভাবে দাবী করলে তুমি তাকে ভালোবাসো?”

“আমি জানি না খালা, তখন আমার মাথা কাজ করেনি।”

“এখন করছে?”

“হুম!”

সৌজন্যের খালা মৃদু হাসে তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক গলায় বলল,

“তুমি ওকে ডিজার্ভ করো না সৌজন্য। ভুল আমার তাই আমি নিজের হাতেই তোমাদের ডিভোর্স ফাইল করাব। আরো একটা কথা, চিটিং ইজ নট এ্য মিস্টেক, ইট’স চয়েজ — যেটা তুমি করেছ! তুমি একটা নরম তুলতুলে মানুষকে চিট করেছো সৌজন্য। আমি যদি শাস্তি দিতে পারতাম; ওই শাস্তি একমাত্র মৃত্যুই হত! তবে আমি তেমন কিছুই করব না… বাকিটা আল্লাহ্ দেখে নেবে…!

চলবে…

  • প্রানেশা আহসান শীতল

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top