সৌভাগ্যবতী বউ

নতুন বিয়ে করা স্ত্রীর সাথে ড্রইং রুমের সোফায় বসে টিভি দেখছিলাম। আর সোফার পাশে মেঝেতে বসে টিভি দেখছিলো দশ এগারো বছরের কাজের মেয়েটি। ওর নাম শেফালি। দরিদ্র ঘরের মেয়ে। বাবা নেই। মা আছে। আমাদের গ্রামে ওদের বাড়ি। সেই সূত্রেই আমাদের চেনে। ওর মা একদিন মেয়েকে নিয়ে গ্রাম থেকে আমাদের বাড়িতে এসে আমার মাকে বললো, মেয়েটিকে যেনো আমরা রেখে দিই। আমাদের এখানে থাকবে, কাজ করবে। মা রেখে দিলেন। তারপর থেকে মেয়েটি আমাদের বাড়িতে থাকে। মাঝে মাঝে ওর মা এসে মেয়েকে দেখে যায়।

আমার স্ত্রী মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো,”তুমি নিচে কেনো বসেছো? সোফায় বসো।”

মেয়েটি আমাদের এখানে আছে দু বছর হলো। সে সব সময় নিচে বসে টিভি দেখে। তাকে কখনো আমরা সোফায় বসে টিভি দেখার কথা বলি নি।

মেয়েটি তাই অবাক এবং কিছুটা ভয় নিয়ে আমাদের দিকে তাকালো। সে বুঝতে পারছে না কী করবে?

স্ত্রী তখন উঠে গিয়ে মেয়েটির হাত ধরে দাঁড় করিয়ে সোফায় বসালো।

এবং হেসে বললো,”এখন থেকে সোফায় বসে টিভি দেখবে। কখনো নিচে বসবে না।”

মেয়েটি জড়োসড়ো হয়ে বসে টিভি দেখতে লাগলো।

কিছুটা দূর থেকে মা দৃশ্যটি দেখলেন।

পরে মা আমাকে তার রুমে ডেকে বললেন,”আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা খুব ভালো একটা বউ পেয়েছি।”

আর বাবা বললেন,”বউটার যত্ন নিবি। আমি নিশ্চিত এই মেয়ে আমাদের জীবন বদলে দেবে। ঠিক যেমন তোর মা আমাদের জীবন বদলে দিয়েছিলো।”

বাবার কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেলো। শহরের আমাদের এক খণ্ড জমি নিয়ে বারো বছর ধরে মামলা চলছিলো। জমিটির বর্তমান মূল্য প্রায় এক কোটি টাকা। জমিটি এক প্রভাবশালী লোক জোর করে দখল করে রেখেছিলো। কিছুদিন পর ঐ মামলার রায় হলো। এবং আমরা জিতলাম।

বাবা সেদিন আদালত কক্ষে আমাকে আবারো বললেন,”বউটার যত্ন নিবি।”

কিন্তু বাবার কথা শেষ পর্যন্ত রাখতে পারলাম না।

একদিন রান্নায় লবণ একটু বেশি হয়েছিলো বলে গলা চড়িয়ে স্ত্রীকে বললাম,”কী রেঁধেছো এসব! মুখেই তো দেয়া যাচ্ছে না।”

আরো বেশ কিছু কথা বললাম।

বাবা তখন ছুটে এসে ধমকে আমাকে বললেন,”ঐ খাবার তো আমরাও খেয়েছি। কই আমাদের তো সমস্যা হয় নি।”

আর মা বললেন,”কথা ভদ্র ভাবে বলবি। বেয়াদবের মতো কথা সহ্য করবো না।”

আমি আর কিছু না বলে বড়ো বড়ো কদম ফেলে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম।

পরদিন অফিসে গিয়ে জানলাম, বড়ো অংকের টাকার হিসেব গণ্ডগোল হয়েছে। আর অফিসের টাকার দায়িত্ব যেহেতু আমার, তাই দোষটা আমার ওপর পড়লো।

বস আমাকে শান্ত গলায় বললেন, টাকার হিসেব যদি না মেলে তাহলে পুলিশকে জানাবেন এবং চাকরিও যাবে।

শুনে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। পুরো অফিস তন্নতন্ন করে খুঁজেও ঐ টাকাগুলোর সন্ধান পেলাম না। অফিসের বাইরে অন্য কোথাও রেখেছি কিনা তাও মনে পড়লো না। দু:সংবাদের এখানেই শেষ নয়। সেদিনই জানতে পারলাম, ঐ প্রভাবশালী লোক, যে আমাদের জমি দখল করে রেখেছিলো, উচ্চ আদালতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। তার মানে, আবারো দীর্ঘদিন ধরে মামলা চলবে। অর্থাৎ আরো খাটুনি এবং টাকা খরচ হবে।

বিধ্বস্ত মনে বাড়ি ফিরলাম। বাড়ি ফিরে প্রথম যে কাজটা করলাম, তা হলো, স্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাইলাম।

সেই সাথে বললাম,”জীবনে আর কখনো তোমার সাথে বাজে আচরণ করবো না। কথা দিচ্ছি।”

স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”শেফালিকে স্কুলে ভর্তি করাতে চাই। আমি নিজে ওকে পড়াবো।”

অপ্রত্যাশিত কথাটা শুনে খানিক সময় ওর দিকে চেয়ে রইলাম।

তারপর বললাম,”তাহলে ঘরের কাজ করবে কে?”

“আমি শুনেছি ওর মা গ্রামে মানুষের বাড়িতে কাজ করে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। তুমি তাকে এখানে নিয়ে আসো। উনি আমাদের বাড়িতে কাজ করবেন। আর মা মেয়ে এক সাথে থাকলে তাদেরও ভালো লাগবে।”

তৎক্ষনাৎ রাজি হয়ে গেলাম। এবং বাবা মাকে বলাতে তারাও রাজি হয়ে গেলেন।

তারপরের ঘটনা অবিশ্বাস্য! অফিসের টাকাগুলো অফিসেরই এক ড্রয়ারে খুঁজে পেলাম। অথচ সেদিন এতো খোঁজার পরও কেনো পাই নি কে জানে! আর দ্বিতীয় অবিশ্বাস্য ঘটনা হলো, ঐ প্রভাবশালী লোকটি আচমকা মামলা তুলে নিলো। লোকটির হঠাৎ এই মন পরিবর্তনের কারণ হলো, লোকটির একমাত্র ছেলের শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়েছিলো।

সেদিন দু হাত ভর্তি মিষ্টি নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন বাবা পুনরায় আমাকে বললেন,”বউটার যত্ন নিবি।”

বাবাকে তখন বললাম,”আপনি সব সময় বউয়ের যত্নের কথা কেনো বলেন?”

বাবা উত্তরে বললেন,”একটা মেয়ে যখন বাবা মা’র বাড়ি ছেড়ে অচেনা এক বাড়িতে আসে, তখন আল্লাহ ঐ মেয়েটার মধ্যে সৌভাগ্য দিয়ে পাঠান। যারা ঐ সৌভাগ্যের যত্ন নেয়, তাদের জীবন আলোতে ভরে ওঠে। আর যারা অযত্ন করে, তাদের জীবন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এটা আমার মুখের কথা নয়। নবীজীর কথা। নবীজী বলেছেন, মেয়েরা হলো বরকত এবং কল্যাণের প্রতীক।”

আমি তখন বুঝতে পারলাম, বাবা কেনো কোনোদিন মায়ের সাথে খারাপ আচরণ করেন নি। আর সেজন্যই হয়তো শূন্য হাতে জীবন শুরু করে আজ উপরে উঠে এসেছেন।

স্টাডি রুমে স্ত্রী তখন শেফালিকে পড়াচ্ছিলো। মেয়েটা পড়াশোনায় ভালো করছে। আমি দরোজায় দাঁড়িয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালাম। সে আমাকে দেখে হাসলো। তখন আমার মনে হলো, চাকরি এবং কোটি টাকার সম্পত্তি পেয়ে যে আনন্দ পেয়েছি, তারচেয়ে অনেক বেশি আনন্দ পেলাম স্ত্রীর হাসি মুখ দেখে।

…….”সমাপ্ত”…….

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
Scroll to Top