রাস্তা পার হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তূর তেজ ঠিক বিকেলের রোদের মতোই ক্ষীণ। আব্বু তার হাতটা চেপে না ধরলে চলে না। আব্বু রোজ থাকে না সঙ্গে। আজও নেই। এক পথিক চাচার পেছনে রাস্তাটা পার হয়ে দ্রুত রিক্সা ধরল।
শীতের রোদ, তবু খাড়া দুপুরে তাপ কড়া। বোরকা-হিজাবের আবরণের নিচে ঘামের স্রোত বেয়ে যাচ্ছিল তার।
ভার্সিটিতে ছাত্র পরিষদের কী এক প্রোগ্রাম ছিল। সেসবে অন্তূর ভালো রকমের বিদ্বেষ আছে। কারণ হিসেবে বলা যায়–তাকে শেখানো হয়েছে এবং বাকিটা নিজস্ব।
অন্তূর ধারণা, ছাত্রলীগ—যাদেরকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অগ্রদূতের নাম দেয়া হয়েছে, তারা মূলত পঙ্গপাল। দলবদ্ধ হয়ে চলা ঘাসফড়িংয়ের জাতকে পঙ্গপাল বলে। দশ-পনেরো লক্ষ একত্রে চলাচল করে। এবং কোনো বিঘাখানেক জমির ফসলি ক্ষেতকে আক্রমণ করলে খুব অল্প সময়ে ক্ষেতের ফসল খুব ভালোমতো পরিষ্কার। এক শ্রেণির লোক অবশ্য এই ক্ষেত পরিষ্কারকে বরবাদ করাও বলবে। তাদের কথা কানে নেয়া উচিত না। ক্ষেতের ফসল উদ্ভিদের জন্য ভারী। উদ্ভিদকে সস্তি দিতেই হয়ত পঙ্গপাল সব ফসল ভক্ষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে। অন্তূর ধারণা, বাংলাদেশের ছাত্রলীগ নামক পঙ্গপাল দেশটা অর্থাৎ বাংলার আবাদী ক্ষেতের জন্য তেমনই এক দল পঙ্গপালের সমান।
আম্মার কল এসেছে কয়েকবার। তাঁর ভাষায়, খুব জরুরী কাজ। অন্তূ জানে, কোনো জরুরী কাজ-টাজ কিচ্ছু না। কিন্তু ছাত্রনেতাদের মুখ-পেটানো মহাবাণী থেকে মুক্তির একটা ছুঁতো দেয়ায় সে মায়ের প্রতি অল্প কৃতজ্ঞ।
দুপুরের ঝাঁজালো রোদে ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে সে অবশ্যই একটি জরুরী কাজ পেল। তাকে দেখতে আসা হয়েছে। প্রায়ই হয় এমন আজকাল। তাতে তার মেজাজ খারাপ হলে কারও কিছু করার নেই। এটা নিয়ম। মেয়ে যুবতী হলে দেখতে আসা হবে। কিন্তু সমস্যা অন্তূর অন্য কোথাও। পাত্রী দেখতে আসা মানুষদের পাত্রী দেখার পদ্ধতি চমৎকার। অন্তূ শুনেছে আগের জামানায় এভাবে দাসী কেনা-বেচা হতো।
মেহমান মোট ছয়জন। পাত্রের মা, ফুপু, বড়বোন, চাচা, ফুপা ও ঘটক। অন্তূকে কোনোরকম বোরকা খুলিয়ে রাবেয়া নিজের একখানা নীল ও গোলাপির মিশেল রঙা শাড়ি পরালেন। গুরুজনেরা বলে গেছেন–পাত্রী দেখাতে শাড়ির বিকল্প নেই। নতুন বউ যেমন হয়, ওভাবে মেয়েকে পাত্রপক্ষের সম্মুখে হাজির করতে হয়। তাহলে চোখে বিঁধে যায়, তারা আন্দাজ করতে পারে বউ হলে বুঝি এমনই লাগবে।
অন্তূর কথামতো পুরুষ দুজন বারান্দায় অবস্থান নিলো। কিন্তু জানালা দিয়ে উঁকিঝুকি দেয়া চলমান।
অন্তূ এতগুলো অপরিচিত মানুষের সম্মুখে অস্বস্তিতে কাতর হয়ে বসে রইল। নজর স্থির রইল মেঝেতে। প্রথমে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসাবাদ হলো। কিন্তু পাত্রের ফুপু সচেতন নারী। তিনি উঠে এসে চট করে অন্তূর মাথা থেকে শাড়ির আবরণ সরিয়ে খোঁপাটা খুলে ফেললেন। একরাশি সামান্য কোকড়া কোমড়-ছোঁয়া চুল বিছিয়ে পড়ল পিঠের ওপর। অন্তূ তখন রাবেয়ার দিকে তাকায়। রাবেয়া ভয় পান মেয়েকে, তার চেয়ে বেশি সেদিন মেহমানদের সামনে তাকে এতিম মতো লাগল। তার কিছুই করার নেই। যা হচ্ছে স্বাভাবিক।
অন্তূকে এপাশ-ওপাশ ঘুরিয়ে দেখা হলো। এত রূপসী কনে তাদের ছেলের পাশে পূর্ণিমার চাঁদের মতোন ঝলমল করবে ভেবে তাদের চোখ চকচক করে উঠলেও নিয়ম তো নিয়মই! তারা পর্যবেক্ষণ জারী রাখল। এই যে অন্তূর দুটো ভুবন-মাতানো চোখেই যে কেউ ঘায়েল, গায়ের রঙ মসৃন ফর্সা, চেহারার ওপর ছোটখাটো মানানসই নাকখানা, সুডৌল থুতনির উপরিভাগে মহান শিল্পীর পেন্সিলের আঁছড়ে তোলা ঠোঁটদুটো! কোনো যুবতীর ক্লান্ত-গম্ভীর মুখখানাও বুঝি চোখ জড়ানো সুন্দর হয়! চুল ছেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে জাদুর লাঠির মতো চিকচিক করে উঠল রূপ। রূপ-রূপ রূপকথার কোনো গম্ভীর রূপাঞ্জনা! রূপসী সব কন্যাই যে সুহাসিনী, লাজুকলতা হবে তেমন কথা আছে নাকি? কেউ কেউ অন্তূর মতো কঠিন-সৌন্দর্যের সত্ত্বাধিকারিণীও হবে। যাদের রূপের বিমোহনে ডুবতে গেলে সঙ্গে কাঠিন্যের এক আঘাতও সহজভাবে গ্রহণ করতে পারতে হবে।
অন্তূর থুতনি ধরে কান, গাল মেপে দেখা হলো। এভাবে অন্তূ মার্কেটে গেলে ম্যানিকুইনের শরীরে ঝোলানো পোশাকগুলো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে কেনার জন্য। সে তীব্র অপমানিত বোধ করতে লাগল। দুজন পরপুরুষ তাকে দেখার জন্য উকিঝুকি মেরে চেষ্টার ত্রুটি রাখছে না। আম্মুর ওপর ক্ষোভ তৈরি হলো। সে বাঁধা দেবার আগেই তার ঘাঁড় আলগা করে দেখা হলো, হাত পা এবং সবশেষে শাড়ি ও পেটিকোট উচিয়ে তার পা দেখতে অগ্রসর হলেন পাত্রের মা। এটা বাড়াবাড়ি হলো কিনা বলা যাচ্ছে না কিন্তু অন্তূ একটানে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনারা মেয়ে দেখতে এসেছেন নাকি হাঁটে গরু কিনতে এসেছেন?ʼʼ
পাত্রের মা অবাক হলেন রূপবতীর নির্ভেজাল গাম্ভীর্যে, এরপর কথাটিতে। তারপর বললেন, “ওমা! এ আবার কেমন কথা? মেয়ে দেখতে এসে মেয়ের পা দেখতে চাওয়া কি অপরাধ নাকি?ʼʼ
-“জি না! অপরাধ নয়, মূর্খতা। আমি কোরবাণীর হাঁটে তোলা কোনো প্রজাতির গবাদী পশু নই যে সবচেয়ে নিখুঁত, আকর্ষণীয় গায়ের রঙওয়ালা, মাংস বেশী, হৃষ্টপুষ্ট দেখে কিনে নিয়ে যাবেন।ʼʼ
রাবেয়া বরাবর এ নিয়ে চিন্তিত থেকে প্রেশার বাড়ান, মেয়েটার মুখের ভাষা কর্কশ। কার মতো হয়েছে তিনি জানেন না।
-“তুমি তো চরম বেয়াদব মেয়ে! কোনদেশি কথা যে, মেয়েকে ভালোভাবে দেখা যাবে না? নাকি কোনো দোষ আছে? বড়দের মুখের ওপর এরকম বদমায়েশের মতো কথা বলছো! আশ্চর্য মেয়ে তো দেখছি! দেখতে আসছি, তো দেখব না?ʼʼ
-“দেখবেনটা কীভাবে? ঠ্যাঙের কাপড় তুলে মেয়ের ঠ্যাঙ দেখবেন ফর্সা কি-না!?ʼʼ
-“এইভাবেই মেয়ে দেখে। তোমার কাছে মেয়ে দেখা শেখা লাগবে না। তুমি শিক্ষিত কিন্তু অসভ্য। ওই শিক্ষার কোনো দাম নাই, বুঝলা? মেয়েদের আসল শিক্ষা নরম স্বভাবে। একটা মেয়েকে বউ করে বাড়িতে তুলব, দেখে-শুনেই তো নেব নাকি?ʼʼ
অন্তূ শাড়ির আচলটা ভালোমতো শরীর ও মাথায় জড়িয়ে নিয়ে বলল, “দুঃখিত, চাচিমা। এটাকে আপনারা মেয়ে দেখা বললেও, আমি ছোটোলোকি বলছি। মেয়ে দেখতে এসে গাল ফেড়ে মেয়ের দাঁত দেখতে হবে, দাঁত উঁচু-নিচু আছে কিনা! মাথার চুল টেনেটুনে দেখতে হবে, চুল আসল না নকল, আছে না নেই, বড়ো না ছোটো? গলা বের করে, ঘাঁড়ের ওড়না খুলে, হাঁটিয়ে, নাচিয়ে এরপর পছন্দ হলে নিয়ে যাবেন! এটাই মেয়ে দেখা তো। অথচ বলুন তো, আমি যা যা বললাম, তা শুনতে এমন লাগল না, যে কোনো গৃহপালিত পশুর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। খরিদ্দার এসেছে গোয়াল থেকে পশু খুলে নিয়ে যেতে! আমার কাছে তা-ই মনে হয়।ʼʼ
রাবেয়া অন্তূর দিকে চোখ গরম করে তাকালেন কয়েকবার। অন্তূর অদ্ভুত লাগল গোটা পরিবেশটা। ঘটক বলল, “এ কেমনে কতা কও, মেয়ে! দেখতে আইলে একটু ভালো কইরেই দেখে মেয়ে। না দেখে শুনে আবার নিয়ে যায় নাকি? বাড়ির বউ হইবা বলে কথা!ʼʼ
অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বড় অনীহার সাথে হতাশ হয়ে জবাব দেয়, “বাড়ির বউ হব, কে বলেছে? সকল পণ্য এক দাড়িতে মাপলে পরিমাপ সঠিক আসবে না। আমি পাত্রপক্ষের মুখাপেক্ষী নই যে পছন্দ না হলে বিয়ে করে নিয়ে যাবে না। আমি এখনও অন্যের মেয়ে। এবং আপনারা আপনাদের তথাকথিত মেয়ে দেখার আয়োজনে রীতিমত আমাকে যথেষ্ট অপমান করে ফেলেছেন। আমি দুঃখিত! এ বাড়িতে আপনাদের পছন্দসই কোনো পাত্রী নেই।ʼʼ
পাত্রর মা অন্তূর মায়ের উদ্দেশ্যে তাচ্ছিল্যের সাথে মুখ বিকৃত করলেন, “আপা! সে আপনি মেয়েকে যতই শিক্ষিত করেন, আদর্শ শিখাইতে পারেন নাই। এরকম মেয়ে কার ঘরে যাবে, আল্লাহ মাবুদ জানে। আপনার কপালে কী আছে এই মেয়ে নিয়ে, আল্লাহ-ই ভালো জানে! অন্তত কোনো ভদ্র পরিবারে তো যাবে না। এই মেয়ে তোমারে অপমান করছি মানে? অপমান কই দেখলা?ʼʼ
অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “নেই, অপমান নেই। আমার ভুলভাল, অসুস্থ মনোভাব। যাহোক, আত্নসম্মানহীনতা যদি আদর্শ হয়, আমি বরাবর অভদ্র এবং জঘন্য আদর্শে পালিত এক মেয়ে। ক্ষমা করবেন এই বেয়াদবকে।ʼʼ
অন্তূ উঠে চলে যায় সেখান থেকে। এরকম ঘটনা প্রথম নয়। তার ভালো বদনাম আছে পাড়ায় এ নিয়ে।
একবার একদল দেখতে এলো। অন্তূর সামনেই ঘটক দেনাপাওয়া মেটানো শুরু করল। অন্তূ হিসেব মেলাতে গিয়ে একটু হিমশিম খাচ্ছিল। বিক্রির নিয়ম নাহয় কিছু কেনার বিনিময়ে কিছু অর্থ দেয়া। কিন্তু যৌতুকের ব্যাপারটা কোন সূত্রের মধ্যে পড়ে? একজন বাবা বিশ-পঁচিশ বছর ধরে খাওয়া, পড়াসহ সমস্ত শখ-আহ্লাদ মিটিয়ে বড় করা মেয়েটাকেও দেবে, এবং সে-ই আবার মেয়ের সঙ্গে অর্থ দেবে! কিছু বিচক্ষণ মানুষ অবশ্য অন্তূর এই দ্বিধা শুনলে একটু চোখ গরম করে বুঝিয়ে বলতো যে, এই যে অন্তূ পরের ঘরে যাবে, চিরকাল খাবে, তার বিনিময়ে কিছু পয়সা তো অন্তূর সাথে দিতেই হয় অন্তূর বাপের।
অন্তূ তখন কী বলতো? সে বোধহয় বলতো, 'তাহলে ছেলেটার সঙ্গেই কিছু পয়সা দিয়ে তাকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিন। আমি কামাই করে খাওয়াব। সে শাড়ি-গহনা পরে ঘর সামলাবে, রাতে আমি কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরলে আমার পা দুটো টিপে দেবে।ʼ
অন্তূর এই মনোভাব রটলে সে হয়ত শুধু পাড়া না, অঞ্চল বা জেলায় বদনাম হয়ে যেত। সমস্যা জটিল।
রাবেয়া অন্তূর রুমে এলেন মিনিট বিশেক পর। বোঝা গেল খুব কষ্টে পরিস্থিতি সামলে মেহমান বিদায় করে এলেন।
অন্তূ জিজ্ঞেস করল, “গেছে তারা?ʼʼ
রাবেয়া থাপ্পর তুললেন, “একটা থাপ্পড় মারব, বেয়াদব মেয়ে! দিনদিন বেলেহাজ হয়ে যাইতেছ তুমি? বেশি লাই দিয়ে ফেলতেছি নাকি আমি? আর কয়টা পাত্রর সামনে আমার মান-ইজ্জত নষ্ট করবি তুই? মা হিসেবে তোকে পার করতে চাওয়ার কোনো হক নাই আমার? পাড়ার লোকে একের পর কথা কথা বলতে ছাড়তেছে না প্রতিদিন। সে-সবই তো শুনতেছি। তুই পরিস্থিতি বুঝবি কোনোদিন? বেকায়দা মেয়েলোক জন্মেছে আমার পেটে!ʼʼ
অন্তূ দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে হাসল, “আম্মা, তোমার তো সবসময় আমার উপর অভিযোগ থাকে। ধরে নিয়ে আসো এসব মূর্খ, ছোটো মানসিকতার লোকদের! তোমার কী ধারণা, যার তার গলায় ঝুলে পড়ব আমি? আব্বু তো বলে না বিয়ের কথা, তুমি কেন কান দাও মানুষের কথায়? আব্বু এজন্যই বলে, তোমার বিবেকে ইমপ্রুভমেন্ট দরকার।ʼʼ
-“তোর বিবেক কাজে লাগা। তা লাগালেই তো মিটে যেত সব। এই দিয়ে কতগুলার সাথে এমন হইলো? পাড়ার লোকে খুব ভালো কয় এতে, তাই না? ভার্সিটিতে পড়াচ্ছি তা নিয়ে কত কথা শুনলাম, এখন বিয়ে করাচ্ছি না তা নিয়ে লোকে কানাঘুষা শুরু করছে। এই যে এসব আচরণ করিস, লোকের কানে যায় না? তোর বাপ তো শিক্ষিত অন্ধ। তার আর কী?ʼʼ
টেবিলের ওপর বইখাতা ছিটানো। শাড়িটা খুলে গোসলে যাওয়া দরকার। সেসব ফেলে সে আম্মুর ঘা ঘেঁষে বসে বলল,
“আম্মু! তুমি দু'দিন না খেয়ে থাকো, কেউ তা নিয়ে আলোচনা করবে না, আর না এক মুঠো ভাত নিয়ে তোমায় সান্ত্বণা দিতে আসবে। কিন্তু যখন তুমি কিছু উন্নতি করবে, সেটাই কেবল মানুষের খোঁচা মারা আলোচনার বিষয় হবে। তাহলে যেই মানুষেরা তোমার কষ্ট আলোচনা করে না, কিছু দেবার ভয়ে, তাহলে তোমার উন্নতির পথে তাদের আলোচনা তোমার কান ছুঁবে কেন?ʼʼʼ
রাবেয়া বেগম স্বর নরম করে একটু অসহায়ের মতো বললেন, “তোর আর তোর বাপের অত ভারী কথা আমি বুঝি না। তুই এতো অবুঝ ক্যান, অন্তূ? মেয়ে মানুষের এতো মুখরা হতে নেই। সমাজে কথা হয়। বোবার কোনো বিপদ থাকে না। চুপ থাকলে নাজাত।ʼʼ
সোজা হয়ে দাঁড়ায় অন্তূ, চোখে-মুখে দ্যুতিময় দৃঢ়তা ফুটে ওঠে তার। গামছাটা ঘাঁড়ে ঝুলিয়ে গভীর এক শ্বাস টেনে হাসে সে, “আমার নাজাত চাই আখিরাতে। বেঁচে থাকতে কীসের নাজাত, আম্মা? যেখানে জীবনটাই টানপোড়েনের এক সমষ্টি মাত্র!ʼʼ
-“এখন বিয়ে যদি নাও যদি করিস, পরে করবি তো! বিয়ের লোক মেয়ের বাড়ি আশেপাশে খোঁজ করে। তোর আশেপাশের লোক তোর ব্যাপার কী বলবে?ʼʼ
অন্তূ একটু হাসল, “সেটা ভাবার প্রশ্নই উঠছে না, যেখানে আমি তেমন কোনো ঘরে যাবই না যারা আমার চরিত্রের সার্টিফিকেট নিতে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরবে।ʼʼ
-“শোন অন্তূ, মেয়েলোকের ঠান্ডা মেজাজের, নরম হইতে হয়। এতো কথা, এতো যুক্তি, এতো প্রতিবাদ! তুই বুঝিস না, এইসব বিপদ আনে খালি। এইসব কি পড়ালেখা থেকে আসতেছে? আমি কি এতদূর তোরে পড়ালেখা করায়ে ভুল করছি?ʼʼ
কিছুক্ষণ চুপ থেকে অন্তূ আরও খানিকটা মুচকি হেসে শান্ত-স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, “আমাকে অন্তূ থেকে অ্যাডভোকেট মাহেজাবিণ আরমিণ অন্তূ হতে এমন বহু চড়াই-উৎড়াই পেরোতে হতে পারে। একজন আইনজীবীর জীবন মুখবন্ধ আর নির্ঝঞ্ঝাট চলতে পারে না, আম্মা! তুমি এটা মেনে নাও, সব ঠিক লাগবে দেখবে। এখন যাও ভাত বাড়ো, চরম খিদে আমার পেটে। আমি গোসল দিয়ে আসি।ʼʼ
—
সারারাত পড়ার পর সকালের দিকে ঘুমানো হয় রোজ। সেদিন ক্লাসটেস্ট পরীক্ষা ছিল। মাসখানেকের ছুটির পর ক্লাস শুরু ভার্সিটিতে। আজকাল ঘনঘন ছুটি চলে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। চারদিক উত্তাল।
দ্রুত উঠে ফজরের নামাজ কাজা আদায় করে রান্নাঘরে উঁকি দিলো অন্তূ। রাবেয়া রান্না করছেন।
-“কিছু খাওয়ার আছে নাকি, আম্মু?ʼʼ
রাবেয়া ঘেমে একটু কাহিল হয়েছেন। কিন্তু অন্তূকে কখনও রান্নাঘরে ডাকা হয় না। আমজাদ সাহেব বলেন, পড়ালেখা করা মেয়েকে সংসারে যুক্ত করতে নেই। পড়ালেখা ও সংসার দুটোই একক বিষয়। দুটো একসঙ্গে হয় না। হয় শুধু পড়ালেখা করতে হয়, নয়ত সংসার।
রাবেয়া শাড়ির আঁচল তুলে কপাল মুছে বললেন, “তোর আব্বুর কাছে বারান্দায় যা, দেখ মুড়ি-চানাচুর দিছি, চা দিছি, বিস্কুট আছে। যা।ʼʼ
অন্তূ দরজা ধরে ঝুলে দাঁত বের করে হেসে বলল, “ডু ইউ নিড অ্যা হেল্পিং হ্যান্ড, মম? আই কুড বি দ্যাট, ইফ ইউ ওয়ান্ট!ʼʼ
-“সেইটা আবার কী? কী বলতেছিস?ʼʼ
-“খাঁটি বাঙাল নারী! মানে আপনার রান্নায় আমার কোনো সাহায্য লাগবে কিনা!ʼʼ
-“চুপচাপ বারান্দায় যা। জ্বালাস না আমারে এখন।ʼʼ
আমজাদ সাহেব পারলে খবরের কাগজে ঢুকে যাবেন। কিন্তু পারছেন না বলে তখনও তাকে বারান্দায় পাওয়া গেল। লুঙ্গি ও ফতোয়ার ওপর একখানা ঘিয়ে রঙা শাল জড়িয়ে খবর পড়ছেন। অন্তূ পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, “কী দেখছো এত মনোযোগ দিয়ে?ʼʼ
আমজাদ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, “সেই গ্রেফতার, বাসে আগুন, হরতাল....ʼʼ
বলতে বলতে অন্তূর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নে, ধর। এত রাত জাগতে বলে কে? বলি, সন্ধ্যায় পড়তে বসবি। চোখ-মুখের কী হাল হয়েছে? আজ থেকে আমি বসব পড়ার টেবিলে।ʼʼ
-“আমি এখনও বাচ্চা নেই, আব্বু। আমি ভার্সিটিতে পড়ি। তো এই বয়সে আমি পড়ব আর তুমি পাশে বসে থাকবে, দেখতে ভালো লাগবে না।ʼʼ
আমজাদ সাহেব ভারী মুখে তাকালে অন্তূ বলল, “তুমি আমায় রাস্তায় পাঠাও একা, আর ঘরে পড়ার টেবিলে পাশে বসে থাকবে! দরকার নেই। কোনো দরকার নেই। একা পথ চলতে পারলে অন্তূ একা পড়তেও জানে। বুঝলে?ʼʼ
আমজাদ সাহেব হেসে ফেললেন। অন্তূ হাসল না। চোখ ছোট ছোট করে বসে রইল। নভেম্বরের সকালের ঠান্ডা ঝিরঝিরে হাওয়া, সঙ্গে আব্বু বসা—অন্তূ বুক ভরে শ্বাস টানে। তার মনেহয় এই জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়েটা নিঃসন্দেহে সে। এই জীবনের চাওয়া-পাওয়া এখানেই ফুরোয়।
আমজাদ সাহেব ভরাট গলায় একটু ধমকে বললেন, “টোস্ট নে। গলা দিয়ে খাবার নামতে চায় না? চা-টুকু শেষ কর। মুড়ি-চানাচুর খালি পেটে খাওয়ার দরকার নেই। চাদর আনিসনি কেন? ঠান্ডা লাগছে না?ʼʼ
নিজের শালটা খুলে অন্তূর গায়ে জড়িয়ে দিলেন। অন্তূর সাহস হলো না আপত্তি করার। সকাল সকাল ধমক খাওয়া ভালো না।
এরপর আপনমনে একটু হাসেন আমজাদ সাহেব, “মা বলতো, 'ও আমজাদ যার শইরে মাংস লাগে না, তার মাতায় পড়ালেহা ছাই ঢুকবো? আয় তো পাকা আম আনছে তোর আব্বায়। দুধ-ভাত মাখাইছি, আয়। পরে পড়বি।ʼʼ
দাদিকে অন্তূ দেখেনি। আব্বু অন্তূকে পেলে মাঝেমধ্যেই আনমনে মায়ের স্মৃতিচারণ করেন। কে জানে অন্তূর ভেতরে তিনি মা দেখেন। অন্তূ নজর লুকিয়ে আব্বুর দিকে তাকিয়ে থাকে। গম্ভীর এই মানুষটা যখন কদাচিৎ সল্প হাসে, সৌম্য পৌঢ়া চেহারায় কী চমৎকার জ্যোতি ফুটে ওঠে! ওই মেহেদি দেয়া দাড়ির নিচে চকচকে সাদা দাঁতের মসৃণ হাসি, অন্তূর বুকে কাঁপন ধরে যায়। এই মানুষটাকে ছাড়া সে কোনো মুহুর্ত কল্পনা করার সাহস রাখে না। আব্বুকে ছাড়া থাকতে পারবে না বলে অন্তূ দূরে কোথাও এডমিশন নেয়নি, তবু তার ইচ্ছে ছিল। আমজাদ সাহেব দিতে দিলেন না। কেন তা জানা নেই। সমস্যাটা অন্তূর মতো কিনা বলা যাচ্ছে না।
-“আমাকে আজ নামিয়ে দিয়ে যাবে একটু ভার্সিটিতে?ʼʼ
আমজাদ সাহেব টান করে ধরে খবরের কাগজের পৃষ্ঠা উল্টে বললেন, “তোর ভার্সিটি সেই দশটায়, আমি সাড়ে আটটার ট্রেন ধরব, একটু পরই বের হব। রিক্সা ঠিক করে দিয়ে যাব। খেয়ে-দেয়ে আরামে যাবি।ʼʼ
কথা বলতে বলতে আমজাদ সাহেব গম্ভীর মুখে হাত বাড়িয়ে অন্তূর কপাল ছুঁলেন। কিছু লেগে ছিল, তা সযত্নে মুছে ভারী গলায় বললেন, “সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল কবে?ʼʼ
-“ক্লাস টেস্ট চলছে, খুব তাড়াতাড়ি ডেইট পড়বে মনে হয়।ʼʼ
ঠান্ডা প্রায় ভালোই পড়ে গেছে। নভেম্বর চলছে। এত সকালে গোসল করলে ঠান্ডা লাগতে পারে। কিন্তু না করলে প্রেশার হাই হবে। অন্তূ আব্বুর পানি গরম করে দিলো। ফতোয়াটা ইস্ত্রী করে একটা বোতাম লাগাল।
খাওয়া শেষ করে আমজাদ সাহেব তৈরি হলেন। হলদেটে সাদা ফতোয়া, সাদা পাজামা পরলেন। হাতে সেই সিলভার রঙা ক্যাসিনো ঘড়ি লাগিয়ে সামান্য একটু আতর ব্যবহার করলেন। বসার রুমে অন্তূ তাঁর চামড়ার স্যান্ডেলখানা মুছে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
আমজাদ সাহেব বেরিয়ে যাবার সময় পিছু ডাকে অন্তূ, “আব্বু!ʼʼ
অন্তূকে দেখতে লাগল অসহায়, ভীতু কোনো শিশুর মতো। আমজাদ সাহেব সামান্য হাসেন তা দেখে।
-“কয়দিন থাকবে ওখানে?ʼʼ
-“দু'দিন দেরি হবে হয়ত। শোন, ক্লাস শেষ করে কাজ না থাকলে সোজা ফিরে আসবি। কোথাও দেরি করবি না।ʼʼ
অন্তূ আস্তে কোরে মাথা নাড়ে, “হু।ʼʼ
আমজাদ সাহেব দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে।
অন্তূ ভার্সিটির জন্য প্রস্তুত হতে হতে রিক্সাওয়ালা এসে হাক ছাড়ল, “অন্তূ মামাণি, আসো গো। আমি আসতে দেরি করি নাই তো? মাস্টার সাহেব কিন্তু আমারে এই সময়ের কথাই কইছে। দেরি হইলে আমার দোষ নাই।ʼʼ
অন্তূর তৈরি হওয়া বলতে কালো বোরকা এবং তার ওপরে কালো ওড়নার আবরণ। শুধু হাত-পা ও তার তীক্ষ্ণ-ডাগর চোখদুটো দৃশ্যমান থাকবে। তৈরি হয়ে বেরিয়ে গিয়ে সে মুচকি হেসে বলল, “না, কাকা। দেরি হয়নি। যথেষ্ট সময় আছে। চলুন।ʼʼ
ভার্সিটির সামনে গিয়ে রিক্সা থামে। ভার্সিটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিও দেশের মতোই অস্থির কিছুটা। দেশটা এক হিসেবে ভালো চলছে। রোজ খু"ন-গুম-কারাবরণ অবিরাম। থামাথামি নেই, সরকারের ক্লান্তিও নেই। খুব পরিশ্রম করছে দেশটাকে নিজের মতো চালাতে। মানুষজন একটু দুশ্চিন্তায় আছে অবশ্য, তবে সরকার ভালো আছে। সে তার মনমতো দেশ চালাচ্ছে। কেউ ভয়ে বিরোধিতা করে না। করলে কারাগার নেহাত কম নয় দেশে। অস্ত্র এবং দেশপ্রেমিক সৈনিকের সংখ্যাও বেশ।
ভার্সিটির ফটকের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা— হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। দিনাজপুরের বাঁশেরহাট থেকে খুব বেশি দূরে নয় অন্তূদের বাড়ি। হলে থাকার প্রয়োজন পড়ে না তার।
ক্যাম্পাসে শহীদ মিনার চত্বরটা অন্তূর প্রিয় জায়গা। সেদিন জায়গাটি পার করার সময় কেউ ডাকল পেছন থেকে,
-“জুনিয়র!ʼʼ
ছয়জন যুবক। অন্তূর সিনিয়র। সামনের জন চেনা চেনা। হয়ত আগে দেখেছে অথবা না। সে এগিয়ে এসে হাতের সিগারেটটা অন্তূর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও, একটা টান দাও!ʼʼ
অন্তূ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতে নেয় ওটা। তার একটি দোষ আছে। সে নিজের ভেতর আর বাহির আলাদা করতে পারে না। যেমন মনে ঘৃণা রেখে মুখে হাসা যায়। কিন্তু তার সেই দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা নেই। সিনিয়রদের প্রতি তার বিদ্বেষ পুরোনো। তা সেদিন বেরিয়ে এসছিল ভুলক্রমে।
অন্তূ আধখাওয়া সিগারেটটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলেছিল, “টান না-হয় দেব একটা, কিন্তু এতে ফযিলতটা কী?ʼʼ
পাখির মতো চঞ্চল দৃষ্টি লোকটার। অন্তূর চোখে চোখ গেঁথে হেসে উঠল সে, “ফযিলত? এই যে আমি তোমারে টান দিতে বলতেছি, এর চাইতে বড়ো ফযিলত বা হাকিকত কিছু নাই, সিস্টার! আর জরুরী তো মোটেই না যে সবকিছুতে ফযিলত থাকা লাগবে! এক টান মারো। স্বাদ ভালো। ব্যান্সন অ্যান্ড হেজেস।ʼʼ
অন্তূ যথাসম্ভব শান্ত ও বিনয়ী স্বরে বলল, “কিন্তু আপনি টান দিতে বললেই দিতে হবে, তা কেন? সিগারেটে অভ্যস্ত নই আমি। এটা আমার সংস্কৃতিও নয়।ʼʼ
অবাক হলে মানুষের চেহারা থমকে যায়। কিন্তু অবাক হয়ে লোকটা হাসল। হাসার সময় তা গা দুলে উঠল, ভঙ্গিমাতে বেপরোয়াপনা।
-“তবু এক টান মারো দয়ালের নামে।ʼʼ
অন্তূ দু-একবার আশপাশে তাকায় বোকার মতোন। কেউ আসার নেই বোধহয় তাকে বাঁচাতে। এর অবশ্য কারণ আছে। মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে– সে কোনো বিপদে পড়েনি। কিন্তু তারা এসে অন্তূর পক্ষে এবং সামনের জনের বিপক্ষে কথা বললে যা হবে, সেটা বিপদ।
হিজাবের আড়ালে অন্তূর শরীরটা দু-একবার ঝাঁকুনি খেলো। এদের চেহারার অধিপত্য ও অঙ্গভঙ্গি স্পষ্ট ভীতিকর। তবু সে পরিষ্কার গলায় বলল, “তবু কেন?ʼʼ
পেছন থেকে কবীর বলে উঠল, “কারণ আমরা সিনিয়র। এরপর আর কোনো ফযিলতের খোঁজ করলে তুমি নিখোঁজ হয়ে যাবা। ঠিক বলি নাই, ভাই?ʼʼ
পেছনের ছেলেরা হাসল। সে বলল, “আলবাৎ সহি কথা কইছিস। তুই আমার লোক হয়ে ভুল কথা বলতেই পারিস না, কইবরা। এইটুকু কনফিডেন্স রাখা উচিত তোর।ʼʼ
অন্তূকে বলল, “মারো টান। আরেকটু হইলে তো সিগারেট শেষ হয়ে যাবে। ছাই জমতেছে। সিগারেট অপচয় করা ভালো কথা না। ষোলো ট্যাকা দিয়ে কিনছি। ব্যান্সন অ্যান্ড হেজেস। খুব ভালো।ʼʼ
-“আপনাদেরকে সিনিয়র লাগছে না। সিনিয়রদের আচরণ এমন হবে না।ʼʼ
সে ভ্রু নাচিয়ে বাহবা দিয়ে অন্তূর মুখের ওপর অশিষ্টভাবে ঝুঁকে এলো, “কেমন হবে, সেইটা তুমি তা জানাবা, ডিয়ার?ʼʼ
অন্তূ ঘৃণায় মুখটা পিছিয়ে নেয়। ভোক ভোক করে গন্ধ আসছে তার মুখ থেকে। মদ ও চুরুটসহ ঘাম, পারফিউম ইত্যাদি মিশে অসহ্য গন্ধ। অন্তূ এ পর্যায়ে বিনয় হারিয়ে মুখ শক্ত করে বলে ওঠে, “জানাতেই পারি। শিক্ষার বয়স হয় না। বলা হয়, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো।ʼʼ
কবীর কিন্তু সহৃদয় ব্যক্তি। সে সাবধান করল, “হুঁশিয়ারী করতেছ? সিনিয়রদের সামনে মুখ চালাচ্ছ? মারা পড়বে, মেয়ে! কবে ভর্তি হয়েছ, কে বড়ো কে ছোটো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারোনি মনে হচ্ছে?ʼʼ
অন্তূ হাসল, “কুকুর ছোটো হোক অথবা বড়ো, তাকে কুকুর বলার সৎসাহসটুকু থাকা অবশ্যই ভালো গুণ! কী বলেন সিনিয়র সাহেব!ʼʼ
কথাটা অন্তূ, ঘাঁড় বাঁকা করে তাকিয়ে থাকা সেই সিগারেটওয়ালা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল। কবীরের খুব হাসি পেয়েছিল ছোট্ট মেয়েটার দুঃসাহসের ওপর। বড় ইচ্ছে করছে নেকাবটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। ফেলাও তো উচিত। মেয়েটা বেয়াদব।
সেই লোক ভ্রু কিঞ্চিৎ জড়ায়, যা খুব সূক্ষ্ণ। তার খুব আনন্দ লাগছে। নতুন ধরণের অভিজ্ঞতা এটা। তাদের সামনে কেউ তো কথা বলে না। মেয়েটা নিশ্চিত তাকে চেনে না।
অন্তূ আবার বলল, “একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তাকে ডেকে সিগারেট টানতে বলা, পানির বোতল ভরানো, জুতো পরিস্কার করানো, আজেবাজে কথা চিরকুটে লিখে তা অন্যকে দেওয়ানো, হ্যারাস করা, হুমকি দেয়া, হলে ডেকে নেয়া–এসব আপনাদের কাছে সিনিয়রের সংজ্ঞা? অথচ আমি যে বই থেকে সিনিয়রের সংজ্ঞা পড়েছিলাম, সেখানে লেখা ছিল–সিনিয়র হলো শিক্ষক, যে জুনিয়রকে আদব শেখাবে, শিষ্টাচার বোঝাবে, একটা ভুল করলে ধমক দিয়ে ভুলটা শুধরে দেবে, কোনো প্রয়োজনে সাহায্য করবে ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুই লেখা ছিল। সেই বই আপনাদের হাতে পড়েনি। দুঃখজনক। মূলত আপনারা রাজনৈতিক পাওয়ার শো করতে এসেছেন, ভুল বলিনি আমি নিশ্চয়ই!ʼʼ
সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে চেপে পিষে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেগুলো অন্তূকে ধরতে গেলে সে বাঁধ সাধল, “উহু! বয়েজ, কুল কুল! চিনিস তোরা মালটাকে?মালটা তো একদম আলাদা রে! সবার চাইতে আলাদা। তার সাথে খেলাটাও হবে একদওওম আলাদা! শালার রাজনীতিতে আসার পর কত্ত ভদ্ররনোক হয়ে গেছি আমি, ভাবা যায়? আমাকে চেনেনি মনেহয়। পাত্তাই দিলো না, ছেহ!ʼʼ
আস্তে করে মুখটা তুলে আকাশের দিকে তাকাল, “কুকুর বলেই খালাস হয়ে গেলে, জুনিয়র! পেটে যে কুকুরের ভীষণ খিদে, সেইটা খেয়াল করলে না! নট ফেয়ার, নোপ! দিস ইজ নট ফেয়ার!ʼʼ
হুট করে আবার আসমান থেকে চোখ নামিয়ে ঘাঁড় নাড়ল দুদিকে, “চ্যাহ! উহহ কী তেজ! আমি ডিস্টার্বড রে!ʼʼ
সিগারেটটা সে তুলল। সেটা কবীরকে দেখিয়ে বলল, “রেখে দে এটা যত্ন করে। পাখি শিকার করার পর একবার করে এটা দেখব, আর... তাই বলে আমার সাথে এভাবে? এ ও আমাকে চেনে? চেনে রে আমাকে? সামনে ইলেকশন! নিজেকে বাঁচিয়ে চলতেছি, তাতে দেখতেছি ম্যালা লোকই রঙ্গ-তামাশা দেখায়ে চলে যাচ্ছে! এইটা কি ঠিক হচ্ছে, বল তো! ইলেকশন তো শেষ হবে তাই না? এরপর কী হবে, তা ভাবছে না কেন এরা?ʼʼ
উন্মাদের মতো হাসল সে। ভার্সিটি চত্বরে লোকজন কম এখন। ক্লাসের ফুল টাইম চলছে। লোক থাকলেও তার যায়-আসার কথা নয়। যে পাশ কাটাচ্ছে, সালাম ঠুকে যাচ্ছে তাকে। সে আবার তাকাল অন্তূর দিকে। অন্তূ ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিল্ডিংয়ে।
চলবে…
written by: তেজস্মিতা মুর্তজা
নোট: উপাখ্যানটিতে অকথ্য গালিগালাজ, আঞ্চলিকতা, নৃশংসতার বর্ণনা রয়েছে। সুতরাং যারা এ ব্যাপারগুলোতে অস্বস্তিবোধ করেন, তাদেরকেএড়িয়ে চলার পরামর্শ রইল। এছাড়াও টুকটাক রাজনৈতিক বিষয়াদি রয়েছে, যা দ্বারা প্রভাবিত হবেন না।
Leave a comment
Your email address will not be published. Required fields are marked *