Buy Now

Search

রুশো [পর্ব-০১]

রুশো [পর্ব-০১]
আমাদের বাসায় ব্যাচেলর ভাড়া একদম অ্যালাউড ছিল না। তবু মিথ্যে কথা বলে, অনুনয় বিনয় করে ও উঠেছিল দোতলায়। ভাগ্যিস তখন বাবা ছিল না দেশে! মা বলে গলাতে পেরেছিল তাকে। মায়ের আবার মনটা বেশ নরম কিনা! বাবা থাকলে নির্ঘাত প্রথম মিথ্যে ধরতে পেরেই পত্রপাঠ বিদায় করত। আমরা তবু সতর্ক করেছিলাম মাকে। এত বছর হয়ে গেল, ঝড়-জল-বৃষ্টি মাথায় কত দুঃখগাঁথা শুনিয়ে ব্যাচেলর ছেলে মেয়েরা উঠতে চাইত বাসায়। বাবা কোনোদিন কাউকে সামান্য সুযোগটা দেয়নি। সেখানে এই নতুন ভাড়াটের মাঝে কি এমন আছে, তার দুটো কথা শুনে মাকে গলে যেতে হবে? মা অবশ্য ফিরতি ধমকই দিয়েছে বরাবর। বলেছে,
-- আমার পেটে তোরা ছিলি নাকি তোদের পেটে আমি? মা'র থেকে এখন বেশি বুঝবি তোরা?
পাল্টা আমরা মাকে শুধরে দেয়ার আর সাহস পাইনি যে পেটে শব্দটা এভাবে প্লুরাল ফর্মে হয় না। একটা মানুষ যেকোনো একজনের পেটে থাকতে পারে। তোদের পেটে শব্দটা আদতে কি ভালো শোনায়?
আমার মায়ের জেদ অনেক বেশি। ঠিক দুষ্টু বাচ্চাদের মতো তাকে যা বারণ করা হয়, সেই কাজটাই বেশি বেশি করতে মায়ের আনন্দ। তারওপর এবারের বিষয়টায় আমাদেরও যেমন একটু নাখোশ ভাব ছিল, তাই নতুন ভাড়াটের প্রসঙ্গে আমাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ, অনাগ্রহও মায়ের পছন্দ ছিল না। উল্টো কড়া ভাষায় সে আমাদের এও জানিয়ে দিয়েছিল, বাবাকে যেন ঘুনাক্ষরেও এ বিষয়ে কিছু না জানানো হয়। যদি বাবা ভুল করেও জানতে পারে, আর মাকে কথা শোনায়, তাহলে সেদিনই ব্যাগ গুছিয়ে নানুবাড়িতে চলে যাবে মা, আর কোনোদিন আসবে না।
আমার পরিবার খুব ফিল্মি টাইপের। এখানে রংমশলা মিশিয়ে যা যা বলা হয়, তা সচরাচর খুব সিরিয়াসলিই বলা হয়। তাই বিরক্ত লাগলেও উচ্চবাচ্য না করে আমাদের মেনে নিতে হয় মায়ের কথা।
তবে মায়ের কথা সেযাত্রা মেনে নিলেও আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিই, যাকে নিয়ে আমাদের মা-মেয়েতে এত মতের অমিল, ঝগড়াঝাঁটি, সেই লোকের ছায়াও আমি মাড়াব না যতদিন সে আমাদের বাড়িতে থাকছে। অবশ্য আমার বিশ্বাস ছিল, ঐ লোকের স্থায়িত্ব আমাদের ছাদে বড়জোর দু মাস। কারণ মিশন থেকে বাবা ফিরলেই তো তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বিদেয় করছে। ঘাড় ধাক্কার সে অভাবনীয় দৃশ্যটা কল্পনা করতেও প্রবল সুখে ভেসে যেতাম আমি বারবার।
তবে আমার সে সুখ ক্ষণস্থায়ী ছিল বলতেই হয়৷ নইলে মাস দুয়েকের নাম করে যাওয়া মিশনের ডিউরেশন হঠাৎ আট মাসে গড়ানোর সংবাদ নিয়ে বাবার মেসেজ আসবে কেন ফোনে দিন সাতেকের মধ্যে?
একদিন সাত সকালে ঘুম থেকে উঠেই বাবার ফেরার ডেইট এতটা পিছিয়েছে শুনে আমার মনটা বড্ড খারাপ হয়ে গেল। লোকটাকে তাড়ানো হবে না সেই আক্রোশে যেমন ফেটে পড়ছিলাম, তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি মন খারাপ লাগছিল বাবাকে দেখতে না পারার কষ্টে। আমি বরাবর বাবা পাগল মেয়ে। সেই ছোট্টবেলা থেকে বাবাকে একমুহুর্ত চোখের আড়াল করাও যে আমার পক্ষে কি অসহনীয় ছিল তা সবাই জানত, এমনকি বাবাও। এ নিয়ে অবশ্য বাবার গৌরব ছিল খুব। তিন মেয়ে আর এক ছেলের মাঝে বড় মেয়ের সবচাইতে প্রিয় হওয়ার আনন্দে প্রায়ই বাবা এটা ওটা বলে মাকে খোঁচাত। মাও অবশ্য আমার বাবাপ্রীতি দেখে কম জেলাস হতো না। আর ওদের দু'জনের বাচ্চামি দেখে আমরা ভাইবোন হেসে লুটোপুটি খেতাম।
মিশনে যাওয়ার পর বাবার সাথে কথাবার্তা হতো না একদমই। হুট করে সে যোগাযোগ করলে যা হতো! আর বাবা সবসময় তার আপডেটগুলো জানাত শুধু আমাকে। কে জানে! অপত্য স্নেহ নাকি বাকি সবার তুলনায় আমার মানসিক দৃঢ়তা বেশি ছিল বলে।
তবে বাবা ছাড়া বড্ড একা লাগত আমার। মনে হতো শকুন হায়েনার পৃথিবীটাকে মোকাবিলা করতে দৃঢ়হাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকলেও মাথার ওপরটা আমার খালিই রয়ে গিয়েছে অপূরণীয় ক্ষতের মতো।
_____________
বাবাকে কাছে না পাওয়া কিংবা মায়ের অতিরিক্ত আহ্লাদের ফলে, নতুন ভাড়াটের প্রতি ধীরে ধীরে একটা রাগের জন্ম হতে শুরু করল আমার। ছায়া না মাড়ানোর সিদ্ধান্তে অটল থেকে নিজের বাড়িতেই খুব সতর্কভাবে চলতে শুরু করলাম আমি। যদিও সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে কিছুটা ভিন্ন ছিল। যতবার যত উপায়ে মানুষটার থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইতাম আমি, ততবার একদম মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আমার সমস্ত পরিকল্পনাকে ধুলিস্মাৎ করে দিতেন তিনি ভারী আনন্দে।
বিষয়টা বুঝলাম কয়েকদিন পর। যেদিন আমার পরিকল্পনার ওপরে ওনার পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠার শুরুটা দেখিয়ে দিলেন ছাদে। বাসার সব বাচ্চাদের ড্রয়িং শেখাতাম আমি ছাদের এককোণে আসন পেতে। খুব সুন্দর ক্রাফটিং করে অতটুকু অংশকে আমার আঁকার স্কুল নাম দেয়া ছিল সেই শুরু থেকে। সেদিনও রোজকার মতো বিকেল বেলা আঁকার স্কুলে বসে পিচ্চিগুলোকে নিয়ে ড্রয়িং করছিলাম মন দিয়ে, অমনি ছাদের অপজিট কর্ণার থেকে গিটারের তীব্র শব্দ ভেসে আসতেই চমকে উঠলাম সবাই মিলে। আমি টিচার হিসেবে বরাবর কড়া। আঁকাআঁকির বেলায় আমার কড়াকড়ি তো সপ্ত আকাশ ছোঁয়া। আঁকার সময়ে বাচ্চারাও আমার ভয়ে তটস্থই থাকত সবসময়। অথচ সেদিন? কি হলো, বিন্দুমাত্র ভয় না পেয়ে নচ্ছার গিটারের সুরে ভেসে ভেসে সব কটা পালিয়ে গেল আঁকা ছেড়ে একদম ছাদের ওই কর্ণারে গিটার বাদকের কাছে।
আমার ভারী রাগ হলো। বেসিকের লাস্ট ক্লাস শেষে পরদিন থেকে ওদের পুরোদমে আঁকার হাত নিয়ে আসব বলে ভেবে রেখেছিলাম। অথচ আমার ভাবনায় এক বালতি পানি ঢেলে কোত্থেকে কোন গিটার বাদকের আমদানি হয়েছে টুংটুং করে মনোযোগ নষ্ট করতে?
কোলের খাতাটা ছুঁড়ে ফেলে প্রবল রাগে উঠে পড়লাম কার এত দুঃসাহস হয়েছে দেখব বলে। একটা ধারণা ছিলই মনে, এ আমার পরিচিত কেউ নয়। নইলে অন্য ভাড়াটেরা তো নিশ্চিত জানে আর যাইহোক রাইনার আঁকার ক্লাসে কোনো ডিস্টার্বেন্স অ্যালাও নয়।
বলতে গেলে অনেকটা আগ্রহ থেকেই গা বাঁচিয়ে চলার প্রতিজ্ঞা ভেঙে দাঁড়ালাম আমি সেদিন গিটার বাদকের সামনে। বুঝলাম অল্পদিনে আমার অদেখা শত্রু নচ্ছার ব্যাচেলর ভাড়াটের সাথে এই বিকেলে হলো আমার প্রথম দেখা৷ সে অবশ্য দেখে এমন ভাব করল যেন কতদিন ধরে চেনে আমাকে। হাত নেড়ে বিরাট এক হাসি দিয়ে বলল,
-- হাই মিস ল্যান্ডলর্ড। ডিসটার্ব দিয়ে ফেললাম?
ওর হাসিতে মোটেও অনুতাপ ছিল না। একপলক তাকিয়েই আমি বুঝতে পারছিলাম অঘোষিত যুদ্ধের প্রথম ধাপে আমাকে হারাতে পেরে বদমাশটা ভালই মজা পেয়েছে। কিন্তু ও আমাদের ভেতরের অঘোষিত যুদ্ধের কথা জানে কি করে? কেউ বলে দিয়েছে আমার প্রতিজ্ঞার কথা?
প্রশ্নটা চট করে মাথায় এলেও ওর ছায়ার থেকে দূরে সরব বলে নিঃশব্দে বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে ওদের ইশারা করলাম নিজেদের জায়গায় ফিরে যেতে। ওরা অবশ্য আর উচ্চবাচ্য করল না। লক্ষীর মতো আঁকার স্কুলে ফিরে গিয়ে রেহাই দিল আমাকে নচ্ছারটার হাত থেকে। আমিও ওদের ফিরে যাওয়ার পর চোখ কটমট করে একবার ওর দিকে তাকিয়ে ফিরতি পথই ধরেছিলাম, বদমাশটা পেছন থেকে আবারও ডেকে কিযেন বলতে নিচ্ছিল।
আমি আর ফিরে তাকাইনি। জানতাম, তাকালেই মনের অসুরটা নেচে উঠে বলত,
-- দে রাইনা এক্ষুনি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দে ওকে দশ তলা থেকে। দেখবি এক ধাক্কায় এমন শিক্ষা হবে! না থাকবে বাঁশ আর না বাজবে বাঁশি।
কে জানে! আমি যদি সায় দিয়ে ফেলতাম অসুরের কথায়। রাগ তো আমার কম ছিল না তার ওপর।
গোটা পরিবারে রাগ আমার একার থাকলেও তিন সাড়ে তিন মাসের গ্যাপে আমার বাড়ির বাকি সদস্যগুলো কিন্তু খুব ভালোভাবেই মিশে গিয়েছিল ওর সাথে। কি জাদুমন্ত্র যে জানা ছিল ওর! ভাইবোনগুলো আমার ও বলতে পাগল ছিল। ওদের পাগলামি তো এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, একদিন বাসায় ফিরে দেখি মা আর ওরা মিলে ছুটোছুটি করে কিসব আয়োজন করছে আমাকে না জানিয়ে। আমি সেদিন সারাদিনই অবশ্য বাইরে; দুটো কোর্সের প্রেজেন্টেশন আর একটানা ক্লাস করে ঢাকার ভয়াবহ জ্যাম ঠেলে রাত আটটায় বাসায় ফিরে দেখি, রান্না বান্নায়, সাজেসজ্জায় এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছে ওরা। মেইনকোর্স, ডেজার্ট থেকে শুরু করে প্রায় পনেরো ষোলো পদের রান্না করে ডাইনিং টেবিল ভরিয়ে রেখেছে মা। আর ভাইবোনগুলো বেলুন ফুলিয়ে, ঝিকিমিকি কাগজপত্র কেটে ঘর সাজানোয় ভীষণ ব্যস্ত। আমি মানুষটা বাসায় ফিরেছি, কারোর ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই এত ব্যস্ত! যদিও আমার রাগ হলো ভীষণ, তবু আগ্রহ দমাতে না পেরে একসময় জানতে চাইলাম,
-- কি ব্যাপার মা, এত আয়োজন কার জন্য? আজ কি কোনো স্পেশাল ডে? কই আমাকে বলনি তো একবারও।
কি কাজে মা তখন ভীষণ ব্যস্ত। গরম তেলের কড়াইয়ে পানি পড়ার মতো ছ্যাত ছ্যাত করছে। সেই অসময়ে আমার প্রশ্নে ভারী বিরক্ত হলো। বিরক্তিভাব চোখেমুখে ফুটিয়ে বলল,
-- রুশোর আজকে জন্মদিন। ছেলেটার মা নেই বাপ নেই, একা দূর শহরে এসে পড়ে আছে। ভাবলাম ওর জন্মদিনটাকে যদি একটু সেলিব্রেট করা যায়! যা রাইনা দাঁড়িয়ে থাকিস না। ওদের সাথে একটু হাতে হাত লাগা। আমি ন'টায় ডেকেছি ছেলেটাকে। উফফ এখনো সব তৈরিই হলো না। কখন যে এসে পড়ে!
শুরুতে নামটা আমি চিনতে পারলাম না। বোকার মতো প্রশ্ন করলাম,
-- রুশো কে আবার?
-- উফফ আজকের দিনে রাগাস না তো। যা, যেটা বলছি কর।
চোখ পাকিয়ে এত ভয়ানক ধমক দিল মা! আমার চড়া মেজাজ আরও চড়া হয়ে গেল। সাথে জমল কিছুটা অভিমান। কোথাকার কোন রুশো টুশো। আমি কি করে চিনব তাকে? জানতে না-হয় প্রশ্নই করেছি। তাই বলে মা এভাবে ধমক দেবে!
হনহন করে ঘরে ফিরে গিয়ে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লাম। ভেবেছিলাম আর বাইরেই যাব না। কার না কার বার্থডে সেলিব্রেট করছে, ওরা একাই করুক। কিন্তু আমার মা, তার জেদের কাছে কেউ পেরে উঠবে কেন?
ঘণ্টাখানেক বাদে বলা নেই কওয়া নেই হাট করে আমার দরজা খুলে কোমরে হাত রেখে গম্ভীর স্বরে আদেশ করল,
-- এক্ষুনি ভালো জামা-কাপড় পরে বাইরে আসো রাইনা। কোনো বায়না শুনব না৷ লোকের সামনে আমার মান ইজ্জত কিচ্ছু রাখছ না তুমি।
আমি একটু গাঁইগুঁই করতাম, তার শান্ত চোখের দিকে তাকিয়ে সাহস হলো না। ভেতরের জমাট বাঁধা রাগ, অভিমান সব ঠেলে সরিয়ে উঠে পরলাম শেষে বাধ্য হয়ে।
তবে রাগটাকে বেশিক্ষণ সরিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। মোটামুটি ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে বেরিয়ে ড্রইংরুমে পা দিতেই বিস্ময়ের আকাশ বজ্রপাতের সাথে আমার মাথায় ভেঙে পড়ল। দেখতে পেলাম ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে আমাদের বদমাশ ব্যাচেলর ভাড়াটে মনের সুখে আঙুর চিবচ্ছে। আর আমার বাকি বোনেরা? প্রজাপতির মতো তাকে ঘিরে রেখে রুশো ভাইয়া এটা খাও, রুশো ভাইয়া ওটা খাও বলে বলে ড্রইং রুম মাতিয়ে রেখেছে।
রুশোর এমন জমিদারি ভাব আমার যতটা বিরক্ত লাগছিল, তারচাইতে কয়েকগুণ বিরক্ত লাগছিল ভাইবোনেদের আলগা বাড়াবাড়ি। এই এরাই কয়েকদিন আগে অচেনা ছেলেকে বাড়ি ভাড়া দিচ্ছে বলে আমার সাথে তালে তাল মিলিয়ে মাকে কত বকেছে, না দেখে, না শুনে রুশোরও কম বংশ উদ্ধার হয়নি। অথচ সেদিনের ওকে গালিগালাজ করা ছেলেমেয়েগুলোই আজ এত আহ্লাদ করে ওর সাথে মিশছে, রুশো ভাইয়া রুশো ভাইয়া বলে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে, দেখেই আমার মাথা ঘোরাতে শুরু করল। মুখ তেঁতো করে এগিয়ে যাব নাকি ঘরে ফিরে যাব ভাবছিলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অমনি ওপাশেরজন আমাকে দেখতে পেয়ে বিশাল এক হাসি দিয়ে বলল,
-- আরেহ মিস আর্টিস্ট ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? কাম জয়েন আস। দুষ্টুগুলো এত এত খাবারের ঝুড়ির মাঝখানে আমাকে বসিয়ে দিয়েছে! যেন খাইয়েই মেরে ফেলবে আজ।
-- মিস আর্টিস্ট নয় তো, আপির নাম রাইনা। জানো রুশো ভাইয়া, মা আপিকে সবসময় বলে, "দুষ্টু মেয়ে রাইনা, করে না আর বায়না"
আপির সবকিছুতে অনেক বায়না তো তাই।
আমি কোনো উত্তর দেয়ার আগেই রুশোর কোলে বসা আমার পাজি ভাই হাসতে হাসতে বোনের মানসম্মান নিলামে তুলে দেয় তারই সদ্য হওয়া শত্রুর সাথে। বিস্ময়ে, রাগে আমার তখন ফেটে পড়ার দশা। চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকাতেই রুশো পাশে থেকে ওর গাল টেনে বলে,
-- দুষ্টু! তোমার আপিকে তো দুষ্টুর চাইতে রাগী মনে হয় বেশি। আন্টির বরং বলা উচিৎ,
"রাগী মেয়ে রাইনা, করে না আর বায়না"
-- কিন্তু ভাইয়া রাগী মেয়েরা তো এমনিতেও বায়না করবে না। তাহলে বায়নার জায়গায় কি বসানো যায় বলো তো?
আমাকে সামনে রেখে এভাবেই আমার ভাইবোনেরা একটা বাইরের মানুষের সামনে বড় বোনের মানসম্মান নিয়ে কাঁটাছেড়ায় লেগে পড়ে প্রবল আনন্দে।
আর রুশোও আমাকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে এমন জ্ঞানী জ্ঞানী ভাব করে ওদের সাথে যুক্ত হয়, যেন আমাকে নিয়ে ওদের হাসি তামাশা কন্সট্যান্ট।
সত্যি বলতে আমি আর অবাক হইনা ওদের গলায় গলায় ভাব দেখে। কয়েকদিনের পরিচয়ে ঘটা করে এমন বার্থডে সেলিব্রেশন এমনি এমনি তো হচ্ছে না। মুখে আমার সাথে তাল মেলালেও আড়ালে সবগুলো মিশে গিয়েছে পাজি গিটারবাদকটার সাথে। না জানে আমার সম্পর্কে আরও কি কি বলেছে ওকে! তাই তো দেখা হলেই সবসময় এমনভাবে সে কথা বলে, যেন আমার কোন সিক্রেট জেনে বসে আছে।
হুহ! ঘরের শত্রু বিভীষণ সব।
_______________________
মা চেয়েছিল রুশোর বার্থডে সেলিব্রেশনে বাকি ভাড়াটেদেরও শামিল করবে। রুশোই মানা করে দিল। বলল, ওর যেহেতু অভ্যেস নেই এসবের, তাই হুট করে অতগুলো অচেনা মানুষ এসে পড়লে অস্বস্তিতে পড়ে যাবে। এছাড়াও বলা নেই কওয়া নেই দু'দিনের ব্যাচেলর ভাড়াটেকে নিয়ে এত আয়োজন, অনেকে ভালো চোখে নাও দেখতে পারে।
দূরে দাঁড়িয়ে আমি অবাক হয়ে দেখলাম জীবনে প্রথমবার কারোর এক কথায় হাসিমুখে নিজের সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলল মা। ছেলেটার মধ্যে অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি আছে, কিংবা বোঝানোর ক্ষমতা, বুঝতে বিশেষ সময় লাগল না আমার। তাহলে এতেই ফেঁসে গিয়েছে আমার মা ভাইয়েরা। সত্যিই এরা এত সাদাসিধে!
এতদিনের ভুলবশত দেখাশোনায় কোনোদিন রুশোর দিকে চোখ মেলে তাকানোর আগ্রহ হয়নি আমার। কিন্তু সেদিন, ওকে নিজেদের চার কামরার ফ্ল্যাটে এত কাছাকাছি আবিষ্কার করার পর না তাকিয়ে পারলাম না।
বলার মতো সুপুরুষ তো সে অবশ্যই। চমৎকার উচ্চতা, পেটানো শরীর, সুন্দর ব্যাকব্রাশ করা ঘন চুল, গায়ের রঙও ভালো, চেহারাও দিব্যি সুকুমার। ঠিক যেন ভেতরে ভয়ানক কিছু লুকানো একটা মিছরির ছুরি মনে হতে লাগল ওকে। রুশোর বিপক্ষে এমনিতেই তো আমার মনে একটা ডিফেন্স মেকানিজম তৈরি হয়ে গিয়েছিল, ওর সুপুরুষ গড়ন এতে আরও জোর দিয়ে আমাকে ওর বিপরীত করতে উঠেপড়ে লাগল।
গোটা সময়টুকু আমি ভীষণ সতর্কতার সাথে ওকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। ছুতো খুঁজছিলাম শুধু একটা ভুল ধরার, তাহলেই যেন ওর খেলা ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিতে পারব কনফিডেন্স ছিল আমার।
কিন্তু অনেক নজরদারি করেও রুশোকে ঠিক বুঝতে পারলাম না। সেলিব্রেশন থেকে শুরু করে ডিনার কমপ্লিট হওয়া পর্যন্ত এত নির্মল আনন্দ আহ্লাদে ও মেতে রইল বাড়ির সব কটা সদস্যের সাথে! একসময় এত সন্দেহবাতিক মন নিয়ে আমার নিজেরই একটু খারাপ লাগছিল। তাহলে কি আমিই বেশি ভাবছি? ওকে শত্রু মেনে নিয়েছি বলে ওর সবেতেই আমার সমস্যা দেখা দিতে শুরু করেছে? কে জানে!
রুশোর সাথে মুখোমুখি কথা হয়নি আমার সেদিনও। মা অনেক ঠেলাঠেলি করলেও একটা স্বাভাবিক দূরত্ব বজায় রেখেই আমি ওদের সাথে থেকেছি পুরোটা সময়। বিষয়টা আমার কাছে খুব স্বাভাবিক লাগলেও রুশোর কাছে বোধহয় ছিল না। তাই তো ডিনার শেষে ওর চলে যাওয়ার আগ মুহুর্তে যখন আমি এঁটো প্লেটগুলো ধুতে এসেছি সিংকে, তখন কি এক বাহানায় আমাকে চমকে দিয়ে ও পাশে এসে দাঁড়াল। মৃদু হেসে খুব ধীর স্বরে বলল,
-- দেখা শেষ হয়েছে আমাকে? কোনো ফল্ট ধরা পড়েছে? আমি মানুষটা কেমন রাইনা?
অপ্রত্যাশিত ঐ মুহুর্তে ওকে রান্নাঘরে দেখে আমি এমনিতেই থেমে গিয়েছিলাম, তারওপর আমার পর্যবেক্ষণ শক্তির ওপরে টেক্কা দেয়া ওর পর্যবেক্ষণ শক্তি দেখে ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়লাম। হাতটা কেঁপে উঠে প্লেটটা পড়েই যাচ্ছিল আমার হাত থেকে, রুশো এগিয়ে এসে প্লেটের অপরপ্রান্ত ধরে ফেলল। হাসিটা তখনও ওর ঠোঁটে লেপ্টে। আমার নার্ভাসনেস বুঝতে পেরেই কিনা! প্রসঙ্গ পাল্টে আবারও ধীরস্বরে বলল,
-- থ্যাঙ্কস ফর মেকিং মাই ডে স্পেইশাল। আজকের এই দিনটাকে আমি কখনো ভুলব না রাইনা। কখনো না।
-- বাট এখানে আমার কোনো কন্ট্রিবিউশান নেই।
নার্ভাসনেস কাটাতে ভাঙা ভাঙা গলায় আমিও প্রতুত্তরের চেষ্টা করলাম। শুনে তার হাসি গাঢ় হলো। ঝুঁকে আমার দ্বিধান্বিত চোখে চোখ রেখে গভীর গলায় বলল,
-- আছে। ইউ জাস্ট ডোন্ট নো।
কে জানে কেন! রুশোর ওই স্বরটা শুনে আমার বুকের ভেতর কেমন অচেনা একটা ঢেউ আলতো করে ধাক্কা দিল। নিজেকে সামলে নিতে নিতেও ভেসে গিয়ে আমি টের পেলাম, রুশোর হাসি সুন্দর।
চলবে,..
 
written by: সিনিন তাসনিম সারা"
Alamgir Hossain

Alamgir Hossain

Hi, I’m Annalise Quitzon, Your Blogging Journey Guide 🖋️. Writing, one blog post at a time, to inspire, inform, and ignite your curiosity. Join me as we explore the world through words and embark on a limitless adventure of knowledge and creativity. Let’s bring your thoughts to life on these digital pages. 🌟 #BloggingAdventures

Leave a comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Your experience on this site will be improved by allowing cookies Cookie Policy